নানা দুর্যোগে ঘরহারা সাত শতাধিক পরিবারের বাস কয়রার বাঁধে
তিন বিঘা ধানি জমি এবং এক বিঘার বসতভিটা ছিল রহিমা বেগমদের। স্বামী সোলাইমান মোল্লা বছরে দুবার ফসল ফলাতেন সেই জমিতে। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে সুখেই ছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেটা ১৩ বছর আগের কথা। এখন তাঁরা কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়ি ঘরের বাসিন্দা। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলায় নিঃস্ব হয়ে আশ্রয় নেওয়ার পর ১৩ বছর কেটে গেছে বাঁধের ওপরই।
খুলনার কয়রা উপজেলার সোনাপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা হয় রহিমা বেগমের সঙ্গে। কপোতাক্ষের বেড়িবাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। নদের মাঝখান দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘ওইখানে ছিল আমাদের ঘর।’ এরপর বলতে থাকলেন, ‘নদীতে মাছ নেই। মাঠেঘাটে কাজ নেই। চলবে কীভাবে? সন্তানদের নিয়ে এখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে টিকে আছি। ১৩ বছর আগে আইলার দিন ঘরবাড়ি, গরু, ছাগল, সহায়-সম্পদ সবকিছুই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কপোতাক্ষের ফুঁসে ওঠা পানি। ভাঙনে গাঙের পেটে যায় ফসলি জমির সবটাই। এখন স্বামী-স্ত্রী মিলে গতর খাটায়ে চলতি হয়। তাই আর ভালো ঘর তুলতি পারিনি।’
রহিমা বেগম একা নন, গোবরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে খুটিঘাটা খেয়াঘাট অবধি কপোতাক্ষ নদের মাত্র আধা কিলোমিটার বাঁধের ওপর এখনো বসবাস করছে ৫০টি পরিবার। যে যেখানে পেরেছে ঘর বানিয়ে বসতি গড়েছে। উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের পাথরখালী এলাকায় বেড়িবাঁধের ওপর এখনো মানবেতর জীবন পার করছে ঘূর্ণিঝড় আইলায় গৃহহারা ২২টি পরিবার। হাজতখালী স্লুইসগেট থেকে কাশীর হাটখোলা পর্যন্ত কপোতাক্ষ নদের বাঁধের ওপর এখনো বসবাস করছে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে গৃহহারা ১৯ পরিবার। মহারাজপুর সুতির অফিস এলাকা থেকে মঠবাড়িয়া বেড়িবাঁধের ওপর বাস্তুহারা মানুষের বসবাসও চোখ এড়ায় না। এ ছাড়া ৪ নম্বর কয়রা লঞ্চঘাট, ৬ নম্বর কয়রা, দক্ষিণ বেদকাশী ও মহেশ্বরীপুরসহ কয়রার সাতটি ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যানদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গোটা উপজেলায় বাঁধের ওপর বসবাস করছে সাত শতাধিক পরিবার।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার বিধ্বস্ত খুলনা উপকূলীয় উপজেলা কয়রার অসংখ্য পরিবার এভাবেই বসবাস করছে বেড়িবাঁধের ওপর। আইলা, সিডর, বুলবুল, আম্পান ও সর্বশেষ ইয়াসের তাণ্ডবে নিঃস্ব হয়েছে বহু পরিবার। কারও জমি চলে গেছে নদীতে, নোনা পানিতে ভেসে গেছে কারও বাড়িঘর। দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আগেই আবার নদীর বাঁধ ভেঙে নোনা পানিতে নষ্ট হয়ে যায় আসবাব-ঘরবাড়ি, সম্পদসহ জমির ফসল।
বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটে কয়রা সদরের ঘাটাখালী হরিণখোলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর চরে সারি সারি মৃত নারকেলগাছ আর বিদ্যুতের খুঁটি ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
উত্তর বেদকাশী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেড়িবাঁধের বাইরে, বাঁধের ওপরে এবং বাঁধের ভেতরে অসংখ্য বাড়িঘর। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত এসব মানুষের এটাই যেন নিয়তি। অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয়নি বলে তাঁরা এখনো এখানেই পড়ে আছেন। এমন একজন পরিমল মণ্ডল, বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই। ওই গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা তিনি। কয়েক বছর ধরে জীবিকার অবলম্বন হিসেবে দোকান করেছেন বাঁধের ওপর। সঙ্গেই থাকার ঘর। পরিবার–পরিজনসহ থাকেন এখানেই। কিন্তু নদীভাঙন তাঁকে তাড়িয়ে ফিরছে। তিনবার বদল করতে হয়েছে দোকান ও বাড়ি। দোকানে নিজের আসন থেকে উঠে এসে এক প্যাকেট বিস্কুট এগিয়ে দিতে দিতে জানালেন, ‘কী করব? যাওয়ার তো কোনো জায়গা নেই। তাই বাঁধের ধারেই আছি। বেচাকেনা তেমন একটা হয় না। তবে চলে যাচ্ছে এভাবেই।’
বৃদ্ধ পরিমল মণ্ডল বলেন, একটা সময় তাঁদের সবই ছিল। সর্বনাশা কপোতাক্ষ সব শেষ করে দিল। চার বিঘা জমির ভিটাবাড়ির মাত্র তিন শতাংশ বাদে বাকিটা গেছে কপোতাক্ষ নদীতে।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহহীন হয়েছেন উপকূলীয় অসংখ্য মানুষ। কেউ খুলনা নগরীতে, কেউ রাজধানীতে, আবার কেউ পার্বত্য অঞ্চল ও দেশান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছেন। পেশা পরিবর্তন ও পেশা হারিয়েছেন বহু মানুষ। আর যাঁরা এলাকায় আছেন, তাঁদের টিকে থাকতে হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে। ঘূর্ণিঝড় আইলার ১৩ বছরেও ভাগ্য বদলায়নি উপকূলীয় কয়রা উপজেলার মানুষের। কয়রায় নদীর চরে অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত তিনটি গুচ্ছগ্রামও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। সেটিও বসবাসের অনুপযোগী।
খুলনা জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে কয়রা উপজেলায় আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় আইলা, সিডর, আম্পানসহ আটটি ঘূর্ণিঝড়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরে সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী, ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে আম্পান, ২০২১ সালের ২৬ মে ইয়াস এবং ২০২১ সালের ৪ ডিসেম্বর ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ছাড়া ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু ও ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা আঘাত করলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল সামান্য।
তবে এসব দুর্যোগে মোট কত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, এর পূর্ণাঙ্গ কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে। তবে বেসরকারি সংস্থার কিছু সমীক্ষা রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) তথ্য বলছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী, দক্ষিণ বেদকাশী, কয়রা ও মহারাজপুর ইউনিয়ন এবং তার পাশের পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী, দেলুটি, গড়ইখালী ও লতা ইউনিয়নের ৪ হাজার ৩১৮ জন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
কোস্টাল লাইভলিহুড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অ্যাকশন নেটওয়ার্কের (ক্লিন) প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর তাঁরা কয়রা ও শ্যামনগরে সমীক্ষা চালান। ওই সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রায় ২১ হাজার মানুষ এলাকা থেকে অন্যত্র চলে গেছেন। ইয়াসের পরও অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, একটি দুর্যোগের ক্ষত না শুকাতেই আরেকটি দুর্যোগের হানা মানুষকে নিঃস্ব করে ফেলে। অসহায় মানুষ যে যেভাবে পারছেন বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের সেখান থেকে সরানো সম্ভব হচ্ছে না। সবচেয়ে বেশি অসুবিধা ফসলি জমি লবণাক্ত হয়ে যাওয়ায়। লবণাক্ততার কারণে বছরের পর বছর ফসল ফলানো সম্ভব না হওয়ায় মানুষের অভাব কমছে না।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রোকুনুজ্জামান বলেন, উপজেলাটি ভৌগোলিক কারণে দুর্যোগকবলিত। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাটি তিন দিক থেকে নদীবেষ্টিত। যে কারণে ছোটখাটো দুর্যোগেও প্লাবিত হয়ে পড়ে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ে। দুর্যোগে এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসনে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি কয়েকটি সংগঠন তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বেড়িবাঁধের ওপর বসবাসকারী লোকজনকেও পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে।