নওগাঁয় বন বিভাগের ৫ হাজার একর জমি বেদখলে
নওগাঁ বন বিভাগের এক–তৃতীয়াংশ জমিই বেদখল হয়ে গেছে। কেউ কেউ এসব জমিতে বসতি স্থাপন করেছেন, কেউ দোকানপাট। কেউ বনের জমিতে আমবাগান করেছেন, আবার কেউ করছেন চাষাবাদ।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের পাশাপাশি শিক্ষক ও সাধারণ মানুষও রয়েছেন দখলদারদের তালিকায়। বনের জমি উদ্ধারে প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় দখল থামছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বন বিভাগের তথ্য বলছে, এক দিনে বনভূমি দখল হয়নি। একটু একটু করে গত ৬০ বছরে জেলার প্রায় ৫ হাজার একর বনের জমি স্থানীয় ব্যক্তিদের দখলে চলে গেছে। দখলদারদের উচ্ছেদে প্রশাসনের কাছে একাধিকবার তালিকা দেওয়া হলেও বড় ধরনের কোনো উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়নি। জমি উদ্ধারে বন বিভাগের পক্ষ থেকে প্রায়ই মামলাও করা হয়। তবে সেগুলো ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। যুগ যুগ ধরে বনের জমি দখল হওয়ায় উজাড় হচ্ছে বন, ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ, হারিয়ে যাচ্ছে বন্য প্রাণী ও কীটপতঙ্গ।
বনের এক–তৃতীয়াংশ জমি বেহাত
নওগাঁর বনাঞ্চলের প্রায় ৮০ শতাংশ পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলায় অবস্থিত। পাইকবান্দা ও সাপাহার রেঞ্জের অধীন পাঁচটি বিটে ভাগ করে বন বিভাগের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, জেলায় ১৭ হাজার ৬৮৩ দশমিক ২৬ একর বনভূমি রয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ১৯৫ একর ভূমি বেদখলে, অর্থাৎ নওগাঁয় মোট বনভূমির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বন বিভাগের দখলে নেই। তালিকায় দখলদারদের সংখ্যা ২ হাজার ১৪৩। তাঁদের দখলে সর্বনিম্ন ৫ শতক থেকে শুরু করে ১২ একর পর্যন্ত জমি রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, একসময় নওগাঁর ধামইরহাট সদর ইউনিয়নের আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যান, ইসবপুর, পত্নীতলার শিহাড়া, নির্মইল ও দিবর ইউনিয়ন, সাপাহারের শিরন্টি ও পোরশার নিতপুর এলাকায় প্রাকৃতিক বনভূমি ছিল। ষাটের দশকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে আসা দরিদ্র শ্রেণির মানুষ জেলার শিহাড়া, নির্মইল, আলতাদিঘি ও ইসবপুর এলাকায় বনভূমির আশপাশে বসবাস শুরু করেন। ধীরে ধীরে এই মানুষেরা বনভূমির জমিতে বাড়িঘর করতে থাকেন। প্রথমে একটি ঘর, পরে আস্তে আস্তে ওই বাড়িতে চার-পাঁচটি ঘর করে বনের জমি দখল হতে থাকে। বনের জমিতে বাড়িঘর হতে হতে ৫০-৬০টি পরিবার মিলে সেখানে মসজিদ-মন্দির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার ও খেলার মাঠ গড়ে উঠতে থাকে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, শুরুর দিকে বন বিভাগের লোকজনের সঙ্গে আঁতাত করে দরিদ্র শ্রেণির লোকজন বনভূমির জমিতে বসবাস শুরু করলেও পরবর্তীকালে স্থানীয় লোকজন ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বনের জমি নিজের বলে দাবি করে জবরদখল করতে শুরু করেন।
সবাই মিলে জমি দখল
পত্নীতলা উপজেলার শিহাড়া, নির্মইল ও দিবর ইউনিয়নের ৭৭টি মৌজায় বনভূমির পরিমাণ ৪ হাজার ৪৬৮ একর। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৭৬ একর জমি দখল করে নিয়েছেন ৯৮৬ জন দখলকারী। দখলকারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ রয়েছেন। দখলদারদের তালিকায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের নামও রয়েছে।
শিহাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেনের নাম রয়েছে দখলদারের তালিকায়। তিনি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১২ বিঘা জমি নিয়ে বন বিভাগের সঙ্গে আমাদের মামলা চলছে। সেই জমি আমার বাবা এক হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে কিনে নেয়। পরবর্তীকালে ওই হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায়। সেই জমির কিছু অংশে ওয়ারিশ সূত্রে আমি পেয়েছি। বন বিভাগের দাবি, সেই জমি নাকি বন বিভাগের নামে এবং গেজেটভুক্ত। এ বিষয়ে মামলা চলমান। এখন আদালতেই প্রমাণ হবে জমিটি আসলে কার।’
হলাকান্দর মৌজাতেই ১৪ জন দখলদারের বিরুদ্ধে ২১টি মামলা চলমান। এসব জমি এক দিনে দখল হয়নি। জমি দখল করে কেউ বসতবাড়ি, আবার কেউ চাষাবাদ করেছেন। এ ছাড়া বনভূমির জমিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থাপনা ও হাটবাজার গড়ে তোলা হয়েছে। মামলা ছাড়া এসব জমি উদ্ধারের কোনো পথ নেই।
নির্মইল ইউনিয়নের পাটুল মৌজায় বন বিভাগের ৩ দশমিক ৭ একর (প্রায় ১১ বিঘা) জমি জালিয়াতি করে দখল নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদসহ আট ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তাঁদের বিরুদ্ধে বন বিভাগের করা একটি মামলা চলমান। আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমাদের এলাকায় খুব কম পরিবারই আছে, যাঁদের বিরুদ্ধে বন বিভাগের মামলা নেই। যে জমি নিয়ে বন বিভাগের সঙ্গে আমাদের মামলা চলছে, সেটি আমরা ক্রয় সূত্রে মালিক।’
শিহাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আফজাল হোসেন বলেন, বিদ্যালয় ভবন ও খেলার মাঠ নিয়ে বন বিভাগের সঙ্গে ১৯৯২ সাল থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষের মামলা চলছে। গৌতম কুমার ও তাঁর ভাই মনোজিৎ কুমার বিদ্যালয়ের নামে জমিটি দান করেন। কিন্তু বন বিভাগের দাবি, জমিটি বন বিভাগের নামে গেজেটভুক্ত।
দিবর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাহাদ জামানের মতে, পঞ্চাশের দশকে ও স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় অনেক হিন্দু পরিবার দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। পরবর্তীকালে এসব জমি খাস খতিয়ানভুক্ত হয়। কিন্তু দেখভালের অভাবে খাস খতিয়ানভুক্ত এসব জমি ধীরে ধীরে দখল হয়ে যায়। অনেকে জাল-জালিয়াতি করে খাসজমি নিজেদের নামে কাগজ করে নিয়েছেন।
৬ মৌজায় জমি বিক্রি বন্ধ দুই যুগ
পত্নীতলার দিবর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার শিহাড়া ইউনিয়নের পাটুল, গুরখি, সিতল ও তেপুকুরিয়া এবং নির্মইল ইউনিয়নের শালকুড়ি ও কইকুড়ি মৌজার প্রায় ৩০০ একর খাস ও বন বিভাগের জমি ভলিউম টেম্পার করে স্থানীয় একটি জালিয়াত চক্র ব্যক্তি মালিকানায় নামজারি করে। ১৯৯৪ সালের দিকে ওই জালিয়াত চক্রের সদস্যরা বন বিভাগ ও খাসজমি তাদের দাবি করে দখল করে নেয়। তখন ওই সব জমিতে উপকারভোগী পাঁচ হাজার মানুষ তৎকালীন জেলা প্রশাসক মাহমুদ হোসেন আলমগীরের কাছে সরকারি জমি রক্ষার দাবিতে স্মারকলিপি দেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখে ওই ছয়টি মৌজার ৯৩৬ একর ৬৬ শতক জমির পর্চা ও অন্যান্য কাগজপত্র জব্দ করে প্রশাসন। পরে এ বিষয়ে মামলা হলে আদালতের নির্দেশে ওই ছয়টি মৌজায় জমি কেনাবেচা ও হস্তান্তর কার্যক্রম বন্ধে আদেশ জারি করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। এ–সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ওই আদেশ এখনো বলবৎ আছে।
ছয়টি মৌজার ভুক্তভোগী জমিমালিকেরা জানান, জালিয়াত চক্রের অপকর্মের কারণে ৩০ বছর ধরে তাঁদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনে স্টাম্পে উভয় পক্ষের জবানবন্দি ও স্বাক্ষরের মাধ্যমে আনরেজিস্ট্রার্ড জমি ক্রয়-বিক্রয় ও হন্তান্তর কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা।
থেমে নেই নতুন দখল
সম্প্রতি পত্নীতলা উপজেলা শিহাড়া ইউনিয়নের হলাকান্দর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাইকবান্দা বন বিট কার্যালয় থেকে ৪০০ ও ৫০০ মিটার দূরে হলাকান্দর এলাকায় আধা পাকা ও টিনের বেড়া দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে।
পাইকবান্দা বিট কর্মকর্তা আহমেদ আলী মণ্ডল বলেন, বনের জমিতে গত এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে ওই দুটি বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। বনের গাছ কেটে সেখানে সাইফুল ইসলাম ও আক্কাস আলী নামের দুই ব্যক্তি বাড়ি দুটি নির্মাণ করেন। বাধা দিতে গেলে জমি কিনে নিয়েছেন বলে কাগজপত্র দেখান। অথচ ওই জমি বন বিভাগের নামে গেজেটভুক্ত। এ ঘটনায় আদালতে মামলা চলমান।
মামলা করলেও নিষ্পত্তি হতে দেরি হওয়ায় জমি উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না বলে দাবি বিট কমকর্তা আহমেদ আলী মণ্ডলের। তিনি বলেন, হলাকান্দর মৌজাতেই ১৪ জন দখলদারের বিরুদ্ধে ২১টি মামলা চলমান। এসব জমি এক দিনে দখল হয়নি। জমি দখল করে কেউ বসতবাড়ি, আবার কেউ চাষাবাদ করেছেন। এ ছাড়া বনভূমির জমিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থাপনা ও হাটবাজার গড়ে তোলা হয়েছে। মামলা ছাড়া এসব জমি উদ্ধারের কোনো পথ নেই।
ধামইরহাট বিট কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ধামইরহাট সদর ইউনিয়ন, ইসবপুর ও পত্নীতলার আমইড় ইউনিয়নের মধ্যে ১ হাজার ৫০০ একর বনভূমি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪০০ একর আয়তনের আলতাদিঘি শালবন জাতীয় উদ্যান রয়েছে। ধামইরহাট বিটের আওতায় বনভূমির কয়েক শ একর জমি বেদখল হয়ে আছে।
ধামইরহাট বিট কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, দখল হয়ে যাওয়া বনভূমির জমির পরিমাণ ও দখলকারীদের তালিকার তথ্য প্রতি মাসেই সংশ্লিষ্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়। দখলকারীদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। মামলার সুরাহাও হয় না, জমিও উদ্ধার হয় না।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রফিকুজ্জামান শাহ প্রথম আলোকে বলেন, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতা বা সহায়তা ছাড়া এসব জমি উদ্ধার করা সম্ভব নয়। উচ্ছেদ অভিযান চালানোর জন্য দখলদার ও বেদখল হয়ে যাওয়া জমিসংক্রান্ত তথ্য সম্প্রতি নওগাঁ জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে।
তবে জেলা প্রশাসক মো. গোলাম মওলা বলছেন, এ বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বন বিভাগের কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর কোনো কথা হয়নি। দখলদারদের কোনো তালিকাও আসেনি। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত জানাতে পারবেন।