মনোজ মিত্রের স্মৃতিচিহ্ন নেই সাতক্ষীরায়, এখানকার ছাত্র শুনে অবাক শিক্ষকেরা
কিংবদন্তি নাট্যকার ও অভিনেতা মনোজ মিত্র সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ধুলিহর গ্রামের সন্তান। এখানকার হওয়া-জল গায়ে মেখে বড় হয়েছেন তিনি। লেখাপড়া করেছেন ধুলিহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু এই গ্রামে তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। নতুন প্রজন্মের তেমন কেউ জানে না, তিনি তাদেরই গ্রামের। এমনকি তিনি যে বিদ্যালয়ে পড়েছেন, সেটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও জানেন না বরেণ্য মানুষটি তাঁদেরই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।
সাতক্ষীরা শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে ধুলিহর গ্রাম। এখনো গাছগাছালিতে ঢাকা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। এই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মনোজ মিত্র। তাঁর জন্ম তারিখ বলা হয় ১৯৩৮ সালের ২২ ডিসেম্বর। গতকাল মঙ্গলবার কলকাতার একটি হাসপাতালে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ধুলিহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক কুমার মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি জানতেন না মনোজ মিত্র ওই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এমনকি এই গ্রামেই তাঁর শৈশব কেটেছে, তা–ও তিনি জানতেন না। তবে তিনি তাঁর নাম শুনেছেন। তাঁর অভিনীত ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ চলচ্চিত্রটিও দেখেছেন।
গতকাল বিকেলে ধুলিহর গ্রামের মিত্রপাড়ায় গিয়ে মনোজ মিত্রের কোনো স্মৃতিচিহ্ন পাওয়া যায়নি। তাঁর পৈতৃক বাড়িটি মিত্রপাড়ার কোন স্থানে ছিল, তা–ও স্থানীয় লোকজন সঠিক করে বলতে পারেননি। তবে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিত্রপাড়ার ধুলিহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের পাশে ময়উদ্দিন সরদারের (৫৭) তৈরি করা পাকা বাড়ির স্থানে তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল। এখন সেই সবের চিহ্নমাত্র নেই। সেখানে ময়উদ্দিন সরদার তৈরি করেছেন দোতলা বাড়ি।
ময়উদ্দিন সরদার প্রথম আলোকে বলেন, ওই জমি তাঁর বাবা কিনেছিলেন মিত্রদের কাছ থেকে। এর বেশি তিনি কিছু বলতে পারেননি। তিনি মনোজ মিত্র কিংবা তাঁর বাবা অশোক মিত্রের নাম শুনেননি। তবে এলাকাটা একসময় মিত্রপাড়া ছিল, এটা জানেন।
ধুলিহর প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত ১৮৮৫ সালে। ১৯৭৩ সালে বিদ্যালয়টি সরকারীকরণ হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে নয়জন শিক্ষক আছেন। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার শ। প্রধান শিক্ষক দীপক কুমার মল্লিকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মনোজ মিত্র এ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, তা তিনি জানতেন না। আলাপচারিতার একপর্যায়ে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ে পুরোনো নথিপত্র সংরক্ষিত আছে। সেখানে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর নাম, বাবার নাম, জন্ম তারিখ, ভর্তির তারিখসহ ঠিকানা আছে। এরপর একটি রেজিস্টার খাতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখা যায়, মনোজ মিত্র ওই বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৪৫ সালের ৫ জানুয়ারি। তাঁর জন্ম তারিখ উল্লেখ আছে ১৯৩৯ সালের ২০ ডিসেম্বর। তাঁর বাবা অশোক মিত্রের পেশা দেওয়া আছে চাকরি। রেজিস্টার খাতায় মনোজ মিত্রের নাম খুঁজে পাওয়ার পর অবাক হন প্রধান শিক্ষকসহ বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকেরাও।
প্রধান শিক্ষক দীপক কুমার মল্লিক বলেন, এই এলাকায় একসময় ছিল ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের বসবাস। এখন ধুলিহরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ নেই বললেই চলে। মিত্রপাড়ার নাম অধিকাংশ মানুষ জানেন না। একসময়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সূতিকাগার ছিল ধুলিহর। সেই ঐতিহ্য হারিয়েছে অনেক আগেই। এ কারণে মনোজ মিত্রদের এলাকার মানুষ চেনেন না, খোঁজও রাখেন না।
কথাসাহিত্যিক বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী বলেন, মনোজ মিত্র সাতক্ষীরা তথা বাংলাদেশের কৃতী সন্তান। ধুলিহর গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ তাঁকে বড় করে তুলেছে। তিনি এক অনন্য অভিনেতা হয়েছেন। তিনি চলতি বছর সাতক্ষীরা আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। জন্মভূমি সাতক্ষীরার মানুষকে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র ও নাটক দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তা স্থগিত করা হয়।
কবি স ম তুহিন বলেন, ‘বড় বৃক্ষ বেঁচে থাকা মানে অনুপ্রেরণা। আমরা প্রেরণা হারা হলাম। “বাঞ্ছা” আর আমাদের মাঝে ফিরবেন না। স্মৃতিগুলোই এখন সম্পদ। এ ভূখণ্ডের গন্ধ গায়ে মাখা তাঁর। আমরা তাঁকে নিয়ে বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান করব আগামীতে।’
শক্তিমান অভিনেতা মনোজ মিত্র সাতক্ষীরায় এসেছিলেন ২০১৯ সালের জুনে। তাঁকে ওই বছরের ২১ জুন সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ওই দিন মনোজ মিত্রের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেছিলেন, শৈশব থেকেই তিনি অভিনয় শুরু করেন। বাড়ির পাশে চণ্ডীতলায় তাঁর অভিনয়ে হাতেখড়ি। বাবা সরকারি চাকরি করার সুবাদে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে তাঁরা সপরিবার কলকাতায় চলে যান। বাবা অশোক কুমার মিত্র স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ঢাকায় ভারতের দূতাবাসে চাকরি করেছেন। ১৯৫৭ সালে কলকাতার নাট্যমঞ্চে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। সিনেমায় পা রাখেন ১৯৭৯ সালে। অভিনয়ের জন্য পেয়েছিলেন ‘সংগীত নাটক একাডেমি’ পদকসহ নানা পুরস্কার। ছিলেন কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যক্ষ।
মনোজ মিত্র বলেছিলেন, সাতক্ষীরার সঙ্গে তাঁর অনেক দিন যোগাযোগ ছিল না। এখন জন্মভূমি তাঁকে টানে। বারবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা হয় ধুলিহরের মাটি। ধুলিহরের মানুষ সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, জন্মভূমিতে কিছু একটা করার। আবার এসে সেসব বিষয় কথা বলবেন বললেও অসুস্থতার কারণে আর সাতক্ষীরায় আসতে পারেননি।