‘১৯৮৮ সালের চেয়ে বেশি বন্যা অইছে, চার দিন ধরি ঘরছাড়া’

বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া ফসলের মাঠ। গতকাল রোববার সকালে মৌলভীবাজারের রাজনগরের দক্ষিণ খারপাড়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

কেউ দোকান খুলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন। গর্ত হয়ে যাওয়া সামনের অংশে মাটি, ইট-সুরকি ফেলছেন। কেউ দোকানের ভিজে যাওয়া আসবাবপত্র, মালামাল বের করছেন, রোদে দিচ্ছেন। কেউ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছেন। পানিতে তলিয়ে থাকার তিন-চার দিনের স্থবিরতা কাটিয়ে নতুন করে আবার সবকিছু শুরু করছেন সবাই। এই স্থানে কবে আর এমন উচ্চতায় পানি হয়েছিল, কারও স্মৃতিতেই তা নেই।

মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলা সদর মনু নদের পানিতে তলিয়ে ছিল তিন থেকে চার দিন। হঠাৎ ছুটে আসা পানিতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন সবাই। যে যেদিকে পেরেছেন, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এক কাপড়ে আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়েছেন। পানির উচ্চতা আন্দাজ করতে না পারায় অনেকের পক্ষেই দোকানের মালামাল, ঘরের জিনিসপত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।

আরও পড়ুন

রাজনগর বাজারের ব্যবসায়ী আলী হোসেন আজ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দোকানেও বুকসমান পানি আছিল। পানি হঠাৎ করি আইয়া ক্যাপচার (গ্রাস) করি লাইছে। আমরার জন্মের পর এমলান (এ রকম) পানি দেখছি না। বহুত মাল (পণ্য) ভাসিয়া গেছে। ভাবছি না এমলান পানি অইবো। বহুত ক্ষতি অই (হয়ে) গেছে।’
আলী হোসেন গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের সামনের অংশ ঠিকঠাক করছিলেন। একইভাবে পাশের একটি ওষুধের দোকানের লোকজনও পানিতে ভিজে যাওয়া আসবাবপত্র ঘর থেকে বের করে সামনে রোদে দিচ্ছিলেন। ঘরের ভেতর শোকেস ভিজে অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। ওষুধপথ্য ভিজে নষ্ট হয়েছে।

আরও পড়ুন

স্থানীয় লোকজন বলছেন, রাজনগর উপজেলা সদরের বাজারে এমন কোনো দোকান, বাসাবাড়ি, অফিস নেই, যেখানে হাঁটু থেকে বুকসমান পানি হয়নি। এ রকম পানি হতে পারে, এ ধারণাই কারও ছিল না। কেউ কেউ ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালের বন্যার কথা মনে করেছেন। কিন্তু সেই পানিতে বাজারের সড়ক তেমন ডোবেনি। বাড়িতে পানি উঠলেও অনেকের ঘরে ওঠেনি। প্রায় সবাই বলেছেন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের বন্যায় পানির উচ্চতা অনেক বেশি ছিল, যা সবার অনুমানকে ছাপিয়ে গেছে। অনুমান করতে না পারায় বিপদে পড়েছেন অনেকেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার ভোররাত থেকে রাজনগর সদরে পানি ঢুকতে শুরু করে। রাজনগর উপজেলার ভাঙারহাটে মনু নদ প্রকল্পের বাঁধ ভেঙে গেলে হু হু করে পানি এসে তলিয়ে যায় সবকিছু। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘরের ভেতর পানি ঢুকে পড়ে। অনেকের পক্ষেই ঘরে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। যে যেভাবে পেরেছেন, পরিবারের লোকজনকে নিয়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সসহ আশপাশের আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে উঠেছেন।

রাজনগরের দক্ষিণ খারপাড়া গ্রামের গফুর মিয়া আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জীবনে এ রকম পানি আর অইছে না। পানি আইছে, কিন্তু ঘরে ওঠছে না। এবার মানুষ দিশা পাইছে না ঘর ছাড়তে।’ একই গ্রামের (দক্ষিণ খারপাড়া) মাহমুদ মিয়া বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকালে কেউ ডাকছে, মাইকেও ঘোষণা অইছে বাঁধ (মনু নদের) ভাঙছে। ডাকাডাকি হুনি ঘুম থাকি উঠি গেছি। উঠিয়াই দেখি ঘরও পানি অই গেছে। মালছামানা নিয়া বের ইতাম পারছি না। যে যার পিন্নর (পরনের) কাপড় লইয়াই বারইছে।’

অন্যদের মতো মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে আশ্রয় নেওয়া মশাহিদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ঘরেও বুকসমান পানি ছিল। ঘরের যে অবস্থা দেখছি, এ অবস্থায় থাকমু কিলা (থাকব কীভাবে) বোঝলাম না। আমার বোঝর (জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার সময়) ভিতরে কোনো দিন এত পানি দেখছি না।’

গতকাল সকালে রাজনগর উপজেলা সদর ঘুরে দেখা গেছে, বন্যার চিহ্ন বাজারের বিভিন্ন স্থানে লেগে আছে। কোথাও টংদোকান পানিতে উল্টেপাল্টে পড়েছে। বিভিন্ন অফিস পানিতে তলিয়ে গেছে। যতটুকু পানি উঠেছিল, ততটুকু পর্যন্ত পানির দাগ রয়ে গেছে। দক্ষিণ খারপাড়া, পুদিনপুর গ্রামে ঢোকার সড়কে এখনো পানি আছে। খারপাড়া গ্রামের সামনের ধানের খেত পানিতে তলিয়ে আছে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে কয়েকজন নারীকে পুঁটলা-পুঁটলি নিয়ে বাড়িতে ফিরতে দেখা গেছে। তাঁরা জানালেন, ঘর থেকে পুরোপুরি পানি নেমে যায়নি। তারপরও যতটুক ভেসেছে, তাতেই সবকিছু ঠিকটাক করতে ঘরে ফিরছেন।

হারুন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৮৮ সালের চেয়ে বেশি বন্যা অইছে এবার। চারদিন ধরি ঘরছাড়া। এখনো (গতকাল রোববার সকাল) ঘরও পানি। পানি পুরা (সম্পূর্ণ) নামলে কইতাম পারমু (বলতে পারব) কোনো দিন ঘরবাড়ি লইমু (যেতে পারব)।’ বৃদ্ধা সফুরা বেগম বলেন, ‘পানিয়ে জ্বালাইছে না, এমন কেউ নাই। আরেক বাড়িত গিয়া জান বাঁচাইছি।’

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজারের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র জানিয়েছে, গতকাল দুপুর ১২টায় মনু নদের পানি রেলসেতুর কাছে বিপৎসীমার ২২৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং চাঁদনীঘাটে ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কুশিয়ারা নদী শেরপুরে ২ সেন্টিমিটার এবং জুড়ী নদী ভবানীপুরে ১৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে ধলাই নদের পানি রেলসেতুর কাছে বিপৎসীমার ২৮২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।