কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের পশ্চিম পাশে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন প্যাঁচারদ্বীপ এলাকা। দু–তিন সপ্তাহ ধরে দ্বীপের ভরাখালে লাগানো বিশাল প্যারাবন দখল করে তাতে তৈরি হয়েছে ৭০০ থেকে ৮০০ ফুট লম্বা দুটি সীমানাদেয়াল। এক্সকাভেটর দিয়ে মাটির বাঁধ ও যান চলাচলের রাস্তা তৈরি হচ্ছে। প্যারাবনের বিরানভূমির কিছু অংশ ভরাটের পর সেখানে তৈরি হবে রিসোর্ট। আর কিছু অংশে হবে মৎস্য খামার। সম্প্রতি সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা গেছে। তবে এ বিষয়ে বন বিভাগ বা প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ নেই।
যেখানে এসব কাজ চলছে, সেখানে ‘কিংশুক ফার্মস লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড দেখা গেছে। তবে সেখানে মালিকের নাম ও যোগাযোগের কোনো ফোন নম্বর দেওয়া নেই।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার অভিযোগ, মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ঢাকার এই প্রতিষ্ঠানকে প্যারাবন দখলে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় খুনিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য কামাল আহমদ ওরফে কামাল মেম্বারের নেতৃত্বে কয়েকজন। ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে প্যারাবন উজাড় এবং এক্সকাভেটর দিয়ে বনের ভেতরে বেড়িবাঁধ ও রাস্তা নির্মাণকাজ তদারক করেন কামাল আহমদ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে কামাল আহমদকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা ধরেননি।
কিংশুক কর্তৃপক্ষ রিসোর্ট ও মৎস্য খামার তৈরির জন্য প্যারাবনের জায়গাটি কিনেছে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে। এখন প্যারাবন উজাড় ও রাস্তাঘাট তৈরি করা হচ্ছে। এতে এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।নুরুল আলম, সাবেক ইউপি সদস্য, খুনিয়াপালং ইউপি
স্থানীয় খুনিয়াপালং ইউপির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি প্যারাবন নিধন করে মাটি ভরাটের দৃশ্য দেখেছেন। প্যারাবন নিধনের বিষয়ে বন বিভাগ শুরু থেকে নীরব বলে তিনি অভিযোগ করেন।
একই ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য নুরুল আলম বলেন, কিংশুক কর্তৃপক্ষ রিসোর্ট ও মৎস্য খামার তৈরির জন্য প্যারাবনের জায়গাটি কিনেছে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে। এখন প্যারাবন উজাড় ও রাস্তাঘাট তৈরি করা হচ্ছে। এতে এলাকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এক্সকাভেটর দিয়ে প্যারাবনের কেওড়াসহ বিভিন্ন গাছপালা উজাড়ের পর সেখানে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার (উত্তর-দক্ষিণ) প্রায় ৮০০ ফুট লম্বা বেড়িবাঁধ দেওয়া হচ্ছে। এ কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক। শ্রমিকদের অধিকাংশ রোহিঙ্গা নাগরিক। দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরিতে শ্রমিকদের আনা হয়েছে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে। বেড়িবাঁধের পূর্ব পাশে তৈরি হয়েছে যানবাহন চলাচলের একটি রাস্তা। প্যারাবন উজাড়ের অংশটি পড়েছে রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের হিমছড়ি এলাকায়।
১৫ থেকে ২০ দিন ধরে প্যারাবন নিধন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং দুই পাশে ইটের দেয়াল তোলা হলেও বন বিভাগ কিংবা উপজেলা প্রশাসনের কেউ এখানে এসে তাঁদের কিছু বলেনি।
প্যারাবনের পূর্ব পাশে বেশ কয়টি বসতি আছে। একটি বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আয়াছ (৪২) বলেন, জন্মের পর থেকে ভরাখালের বুকে প্যারাবন দেখে আসছেন তিনি। এক বছর আগেও এই প্যারাবনে মাছ শিকার করতেন তিনি। এখন গাছগুলো কেটে প্যারাবন দখল করা হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে মাদক মামলার আসামি করে এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়।
প্যারাবনের ভেতরে বাঁধ নির্মাণের কাজ করা রোহিঙ্গা শ্রমিক আবদুল গফুর বলেন, কামাল মেম্বারের লোকজন তাঁদের ক্যাম্প থেকে প্যারাবনে নিয়ে আসেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে তাঁরা ৩০০ টাকা মজুরি পান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন শ্রমিক বলেন, ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে প্যারাবন নিধন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং দুই পাশে ইটের দেয়াল তোলা হলেও বন বিভাগ কিংবা উপজেলা প্রশাসনের কেউ এখানে এসে তাঁদের কিছু বলেনি।
সাইনবোর্ডের পশ্চিম পাশে প্যারাবনের কাছে তৈরি হয়েছে একটি টিনের ঘর। কিংশুক কর্তৃপক্ষের দখলে নেওয়া জায়গার দেখভাল করেন স্থানীয় বাসিন্দা আমির হোসেন। তিনি বলেন, রিসোর্ট ও মৎস্য খামারের জন্য কিংশুকের মালিকপক্ষ কামাল মেম্বারের কাছ থেকে প্যারাবনের জায়গাটি কিনেছেন।
বন কর্মকর্তা বলেছেন, প্যারাবনের জায়গাটি সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত। ব্যবস্থা নিলে রামু উপজেলা প্রশাসন নিতে পারে। তবে রামুর ইউএনও বলেছেন, প্যারাবনের জায়গাটি বন বিভাগের হতে পারে।
প্যারাবন নিধনের খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের সদর বন রেঞ্জ কর্মকর্তা সুমির রঞ্জন সাহা বলেন, প্যারাবনের গাছ উজাড় এবং সেখানে নির্মাণকাজ চললেও বন বিভাগের কিছু করার নেই। প্যারাবনের জায়গাটি সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত। ব্যবস্থা নিলে রামু উপজেলা প্রশাসন নিতে পারে। বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। স্থানীয় কামাল মেম্বার ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্যারাবনের জায়গাটি বিক্রি করেছেন বলে তিনি মানুষের কাছ থেকে শুনেছেন।
এ প্রসঙ্গে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা মুস্তফা স্বর্ণা বলেন, প্যারাবন নিধন করে সীমানাপ্রাচীর, বেড়িবাঁধ ও যান চলাচলের রাস্তা তৈরির কথা তাঁকে কেউ জানাননি। এ ব্যাপারে তিনি ব্যবস্থা নেবেন। তবে প্যারাবনের জায়গাটি বন বিভাগের হতে পারে বলে তিনি জানান।