আড়াইহাজারে নিজের প্রার্থী ঘোষণা করে তাঁর পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করছেন হুইপ নজরুল
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ নজরুল ইসলাম ওরফে বাবু। এতে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে ভোটার ও প্রার্থীদের মনে।
অভিযোগ উঠেছে, নিজের পছন্দের লোককে দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পর অপর এক প্রার্থীর সমর্থক অনুসারীদের মুঠোফোনে হুমকিও দিচ্ছেন নজরুল ইসলাম।
আড়াইহাজার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে আগেই নজরুল ইসলামের দুই পছন্দের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের ৯ জন নেতা-কর্মী প্রার্থিতার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তিনজন নির্বাচনের মাঠে আছেন। তাঁরা হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজালাল মিয়া (দোয়াত কলম প্রতীক), উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি সুজন ইকবাল (আনারস প্রতীক) এবং কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম ওরফে স্বপন (ঘোড়া প্রতীক)।
সাইফুল পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্য আলোচিত রুবেল মাহমুদ হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি। তাঁকেই গত ৪ মে এক সভায় দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছেন হুইপ নজরুল।
কিছুদিন আগেই সাইফুল ইউপি নির্বাচনে বড় ব্যবধানে হেরেছেন। তা ছাড়া তিনি বিতর্কিত। একক প্রার্থীর বিষয়টা ফোরামে পাস হয়নি, তাই একাধিক প্রার্থী মাঠে থাকেন। হুইপ তখন নিজে সভা করে সাইফুলকে দলের প্রার্থী ঘোষণা করেন। আমরা তো চাইলেও এখন আর অন্য প্রার্থীর ভোট করতে পারছি না।
গতকাল বৃহস্পতি ও আজ শুক্রবার দুই দফায় আড়াইহাজার উপজেলায় ঘুরে ভোটার, প্রার্থী এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে। আড়াইহাজার বাজার এলাকার একটি চায়ের দোকানে কথা হয় ইজিবাইকচালক মাহমুদ আলীসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁদের ভোট নিয়ে ভাবনা জানতে চাইলে মাহমুদ বলেন, ‘ভাইয়ে ভাইয়ে কুস্তি খেলা। বাপ-মা পক্ষ নিছে এক পোলার। এমনকি হেরা আগেই আরেক পোলার মাজা ভাইঙ্গা দিছে। এহন কন, আপনে হেই খেলা দেইখা সময় নষ্ট করবেন?’
মাহমুদ আলীর এমন সরস জবাবে দোকানে উপস্থিত আকরাম হোসেন, শাহজাহান মিয়া, দেলবার আলীরা হেসে ওঠেন। আলাপে জানা যায়, আড়াইহাজারের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলামকে উপজেলার একক নিয়ন্ত্রক মনে করেন এই ভোটাররা। অন্তত গত ১৫ বছরে নজরুলের পছন্দের বাইরে গিয়ে কেউ সেখানে জনপ্রতিনিধি হতে পারেননি। নজরুল যেহেতু এবার সাইফুল ইসলামকে নিজের প্রার্থী ঘোষণা করেছেন, ফলে যেকোনো উপায়ে সাইফুলকে বিজয়ী করা হবে বলে ধারণা এই ভোটারদের। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বর্জন করা এই নির্বাচনে তাই আলাদা করে তেমন আগ্রহ নেই তাঁদের। তবে ভোটের দিন পরিবেশ সুষ্ঠু থাকলে কেন্দ্রে যাওয়ার কথা ভাববেন তাঁরা।
আড়াইহাজারের সব জনপ্রতিনিধি ও দলীয় নেতা-কর্মীরা মিলে যৌথভাবে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি সেই সিদ্ধান্তের পক্ষে। আমার নিজস্ব কোনো প্রার্থী নেই। আর হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগগুলো বানোয়াট।
ভোটারদের এমন মনোভাবের কারণ জানা গেল উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘দলের চাওয়া, ভোটাররা যেন কেন্দ্রে আসেন। এই কারণে দল একক প্রার্থী দেয়নি। পরে হুইপ দলীয় ফোরামে সাইফুল ইসলামকে একক প্রার্থী করার প্রস্তাব দেন। কিছুদিন আগেই সাইফুল ইউপি নির্বাচনে বড় ব্যবধানে হেরেছেন। তা ছাড়া তিনি বিতর্কিত। একক প্রার্থীর বিষয়টা ফোরামে পাস হয়নি, তাই একাধিক প্রার্থী মাঠে থাকেন। হুইপ তখন নিজে সভা করে সাইফুলকে দলের প্রার্থী ঘোষণা করেন। আমরা তো চাইলেও এখন আর অন্য প্রার্থীর ভোট করতে পারছি না। এই কারণে ভোটারদের মনে ভোট নিয়া সন্দেহ থাকতে পারে। তাঁরা মনে করতে পারেন, আগেই সব সিলেকশন হয়ে গেছে।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একক প্রার্থী ঘোষণা আওয়ামী লীগের দলীয় নীতিবহির্ভূত। হুইপ যদি কাউকে দলের প্রার্থী ঘোষণা দেন, তাহলে ভোটের নিরপেক্ষতা হারায়।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, প্রতীক বরাদ্দের পর প্রায় প্রতিদিনই দলীয় কার্যালয়গুলোতে বর্ধিত সভার আয়োজন হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো সভা করে সাইফুল ইসলামের পক্ষে নির্বাচন করার ঘোষণা দিচ্ছে। সংসদ সদস্য ৪ মে এক সভা বক্তব্যে বলেন, ‘শেখ হাসিনার দলের প্রার্থী হিসেবে আমাদের একক প্রার্থী হলো ঘোড়া মার্কার স্বপন।’ তার পর থেকে বিভিন্ন সময় তিনি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সাইফুল ইসলামের জন্য ভোট চেয়েছেন। সর্বশেষ আজ শুক্রবার খাগকান্দা ইউনিয়নে সভা করে তিনি সাইফুলের জন্য ভোট চেয়েছেন। সাইফুল ইসলামও ভোটারদের কাছে নিজেকে হুইপ নজরুলের প্রার্থী বলেই পরিচয় দিচ্ছেন।
অথচ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালার ধারা-২২-এ বলা হয়েছে সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নির্বাচনের প্রচারণা বা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না।
একজন প্রার্থীর পক্ষে সংসদ সদস্যের অবস্থান নেওয়া গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করেন দোয়াত কলম প্রতীকের প্রার্থী শাহজালাল মিয়া। তিনি বলেন, ‘হুইপ নিজে যখন একজন প্রার্থীর পক্ষে সরাসরি কাজ করেন, তখন আর মাঠের নিরপেক্ষতা থাকে না। আমার পক্ষে কাজ করায় তিনি অনেককেই ফোন করে হুমকি দিচ্ছেন। আমি দল এবং প্রশাসনের কাছে উৎসবমুখর ও সুষ্ঠু একটি ভোট প্রত্যাশা করছি।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য ও হুইপ নজরুল ইসলাম আজ রাত ৯টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আড়াইহাজারের সব জনপ্রতিনিধি ও দলীয় নেতা-কর্মীরা মিলে যৌথভাবে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি সেই সিদ্ধান্তের পক্ষে। আমার নিজস্ব কোনো প্রার্থী নেই। আর হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগগুলো বানোয়াট।’
তবে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাকিব-আল-রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হুইপ নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন না। এ বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেব। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের জন্য যা যা করণীয়, তার সব ব্যবস্থাই আমরা নিয়েছি।’