কুমিল্লায় আবার বেপরোয়া ‘কিশোর গ্যাং’, ছোটদের হাতে ঘটছে বড় অপরাধ
কুমিল্লা শহরে আবারও আতঙ্ক হয়ে ফিরে এসেছে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি। অল্প বয়সী কিশোর-তরুণদের বেপরোয়া তৎপরতায় শহরের বাসিন্দারা তটস্থ। ২০১৭ সালের পর গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের হাতে ৮ বছরে অন্তত ১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া মাদক কারবার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিংয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে এসব গ্যাং। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার বিকেলে নগরের কান্দিরপাড় এলাকায় ভিক্টোরিয়া কলেজ–সংলগ্ন রানীর দিঘির পাড়ে অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের অর্ধশতাধিক সদস্য। এ সময় ককটেলের বিস্ফোরণও ঘটানো হয়।
কান্দিরপাড় এলাকার ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুক্রবার বিকেলে রানীর বাজার সড়ক দিয়ে কান্দিরপাড় দোকানের দিকে আসছিলাম। হঠাৎ দেখি, কিশোর গ্যাং অস্ত্র হাতে রানীর বাজারের দিকে যাচ্ছে। ভয়ে আমার প্রাণটা যেন যায় যায় অবস্থায় ছিল। নিয়মিত পুলিশের অভিযান না থাকায় তারা বেপরোয়া হয়ে পড়েছে।’
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পুলিশের। কিন্তু পুলিশ বাহিনী এখনো কোনো না কোনো অজুহাতে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগে যেই অবনতিশীল অবস্থায় ছিল, সেটা থেকে উত্তরণের তেমন কোনো পথ এখনো তৈরি হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সালের দিকে কুমিল্লা নগরে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। রতন ও ঈগল ছাড়াও নগরের আলোচিত কিশোর গ্যাং গ্রুপ হচ্ছে র্যাক্স, এক্স, এলআরএন, সিবিক, মডার্ন, রকস্টার, ডিস্কো বয়েজ, বসসহ শুধু কুমিল্লা নগরেই কিশোর গ্যাংয়ের কমপক্ষে ২০টি পক্ষ আছে। এসব গ্যাং নিজেদের আধিপত্য দেখাতে প্রকাশ্যে সহিংসতায় জড়াচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৪ ডিসেম্বর রাতে নগরের অশোকতলা এলাকায় সজীব হোসেন ওরফে বাবু (২২) নামের এক তরুণকে পিটিয়ে ছুরিকাঘাত করা হলে পরদিন সকালে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। পুলিশ বলছে, ওই ঘটনার নেপথ্যে ছিল কিশোর গ্যাংয়ের মাদক কারবার। নিহত সজীব দেবীদ্বার উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের মফিজুল ইসলামের ছেলে। তাঁরা অশোকতলা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। নিহতের বড় বোন সনিয়া আক্তার বলেন, তাঁর ভাই কুমিল্লা নগরে একটি সুপারশপে কর্মী হিসেবে কাজ করত। যারা খুন করেছে, তারা ভয়ংকর কিশোর গ্যাং।
এর আগে গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা নগরের সবচেয়ে আলোচিত কিশোর গ্যাংয়ের দুটি পক্ষ ‘ঈগল গ্রুপ’ ও ‘রতন গ্রুপ’ সদস্যদের মধ্যে সশস্ত্র মহড়া ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় উভয় পক্ষের সদস্যরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এ ঘটনায় দুই পক্ষের ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েক মাস চুপচাপ থেকে এ দুটি গ্যাং আবার বেপরোয়া হয়ে পড়ে।
২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে নগরের দক্ষিণ চর্থা বড়পুকুর পাড় এলাকায় ‘থার্টি ফার্স্ট নাইটের পার্টি’ থেকে ডেকে নিয়ে ফয়সাল ইসলাম (১৯) নামের এক তরুণের হাত-পায়ের রগ কেটে এবং কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০২২ সালের ১৯ আগস্ট নগর উদ্যানের সামনে শাহাদাত হোসেন নামে (১৫) এক কিশোরকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল কুমিল্লা ইপিজেডের একটি চীনা কোম্পানির কর্মকর্তা খায়রুল বাশারকে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ইপিজেডের সামনে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনা কিশোর গ্যাং ঘটায় বলে জানিয়েছিল র্যাব। একই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি নগরের ঠাকুরপাড়া এলাকার মোহাম্মদ আমিন (১৫) নামের এক কিশোরকে পিঠে ও বুকে ছুরিকাঘাত করে খুন করে কিশোর গ্যাং।
কিশোর গ্যাংগুলোর অপরাধ সংঘটনের পরিমাণ যতটা, সে অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। গত বছরের ২৪ মে নগরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৩৯ কিশোর গ্যাং সদস্যকে আটক করে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। একই দিন রাতে অভিভাবকদের মুচলেকায় ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের। গত বছরের ১১ অক্টোবর ছয়টি কিশোর গ্যাংয়ের নেতা তানজিম আবদুল্লাহকে (২০) দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ জানায়, তানজিম সিবিকে (কুমিল্লা ব্রাদার্স কমিউনিটি), সিবিকে ডেঞ্জার জোন, সিবিকে জুনিয়র, সিবিকে স্পেশালসহ ছয়টি গ্যাং গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।
কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মহিনুল ইসলাম আজ শনিবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, বিগত সময়ে এসব কিশোর গ্যাং বেপরোয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের একশ্রেণির নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায়। এখন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বিএনপির সঙ্গে মিশে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যার সর্বশেষ দেখা গেছে শুক্রবার বিকেলে। বিভিন্ন সময়ে কিশোর গ্যাং সদস্যদের ধরতে অভিযানের কথা জানিয়ে ওসি মহিনুল ইসলাম আরও বলেন, শুক্রবার কিশোর গ্যাং রতন গ্রুপ এই অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে। তাদের ধরতে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। আশপাশের সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে পুলিশ।