২৩ দিন ধরে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা তেঁতুলিয়ায়
প্রথম ফসল গেছে ঘরে
হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে
শুধু শিশিরের জল;
অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে
হিম হয়ে আসে
বাঁশপাতা-মরা ঘাস-আকাশের তারা;
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা;
ধানখেতে-মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা;
জীবনানন্দ দাশের লেখা ‘পেঁচা’ কবিতার পঙ্ক্তির মতো দেশের সর্বোত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে কার্তিকের শুরুতেই ঝরতে শুরু করেছে ‘ধারালো কুয়াশা’। কাটা শুরু হয়েছে কৃষকের পাকা ধান। উত্তরের হিমেল হাওয়া নিয়ে এসেছে শীতের আগমনী বার্তা। দিনভর ঝলমলে রোদ আর গরম থাকলেও সন্ধ্যা নামলেই শুরু হচ্ছে শীতের আবহ। রাতভর ঝরতে থাকা কুয়াশা থাকছে সকাল পর্যন্ত।
হিমালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় উত্তরের এই জনপদে প্রতিবছর শীতের আগমন ঘটে কিছুটা আগেভাগে। আর শীত বিদায়ও নেয় দেরিতে। রাতভর টিপটিপ বৃষ্টির মতো ঝরে কুয়াশা। সকাল ৮টার পর ঝলমলে রোদের দেখা মেলে। দিনের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। দিনে গরম, রাতে হালকা ঠান্ডা ও ভোরে বেশ ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। সন্ধ্যার পর এই জনপদের বেশির ভাগ মানুষই মোটা জামা পরে বের হচ্ছেন। সেই সঙ্গে রাতে ঘুমাতে হচ্ছে কাঁথা-কম্বল গায়ে জড়িয়ে। তবে এমন আবহাওয়ায় শীতের নানা রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে সচেতন ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
পঞ্চগড় জেলা সিভিল সার্জন মোস্তফা জামান চৌধুরী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে দিনে গরম এবং রাতে হালকা ঠান্ডা থাকায় মানুষের মধ্যে সর্দি-কাশিসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতার সঙ্গে যত্ন নিতে হবে, যা সব সময়ই নেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া এই সময়ে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার ও শাকসবজি বেশি খেতে হবে।
আজ সোমবার সকালে পঞ্চগড় সদর উপজেলা শিংপাড়া এলাকায় ধান কাটছিলেন জয়নুল হক (৫০) নামের এক শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘সারা রাইত খুব কুয়াশা। কুয়াশার তানে (জন্য) ধানের গাছ ভিজে সকালে কাটিতে কনেক (একটু) কষ্ট। কিন্তু কি করিবেন, সকালে শুরু না করিলে কাজ আগায় না। এক বিঘা ধান কাটিলে ১ হাজার ৫০০ টাকা পামো।’
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা যায়, আজ সকাল ৯টায় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সারা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল রোববার বেলা তিনটায় তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ১৫ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত টানা ২৩ দিন তেঁতুলিয়ায় সারা দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময় তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করেছে। সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত শীত অনুভূত হলেও দিনভর তীব্র রোদে গরম অনুভূত হচ্ছে। এতে দিন ও রাতের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে। ২৩ দিন ধরে তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হলেও তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠানামা করেছে।
আজ সকালে জেলা শহর ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কুয়াশায় কোথাও কোথাও ভিজে গেছে পিচঢালা পথ। গাছের পাতা, পাকা ও আধা পাকা ধানের খেত আর সবুজ ঘাসের ওপর জমে আছে শিশিরবিন্দু। বিএনপির ডাকা অবরোধের কারণে সড়ক-মহাসড়কে খুবই কমসংখ্যক দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল করছে। কৃষক-শ্রমিকেরা কেউ কেউ ধানখেতে কাটছেন পাকা ধান। কেউবা বিক্রির জন্য সবজি খেত থেকে সংগ্রহ করছেন। কেউ আবার ভ্যানে করে বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের উৎপাদিত বাহারি সবজি। কর্মস্থলে ছুটতে দেখা গেল কিছু মানুষকে। আবার কেউবা বের হয়েছেন হাঁটতে।
আমিরুল ইসলাম নামের এক পথচারী বলেন, এখন ঠান্ডা খুব বেশি না। কিন্তু রাতে আর সকালে কুয়াশা একটু বেশি। রাতে কাঁথা-কম্বল নিয়েই ঘুমাতে হয়। আর দিনের বেলা তো অনেক রোদ থাকে। এভাবেই দিন দিন শীত বাড়তে থাকবে।
সকালে বলেয়পাড়া এলাকায় খেত থেকে বেগুন সংগ্রহ করছিলেন কৃষক হাসিবুল ইসলাম (৩৫)। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘সকাল সকাল বাজার ধরার জন্য লোকজন নিয়ে বেগুন তুলতে এসেছি। যখন আসি তখন অনেক কুয়াশা ছিল, এখন ধীরে ধীরে কমছে। সপ্তাহখানেক আগে প্রতি মণ বেগুন পাইকারি ১ হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছি। দুই দিন থেকে অবরোধের কারণে এক হাজার টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে।’
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের পর্যবেক্ষক মো. সামিউজ্জামান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, টানা ২৩ দিন ধরে তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে। রাতে ঝরতে শুরু করা কুয়াশা সকাল পর্যন্ত থাকছে। এ ছাড়া দিনের বেলা রোদ ওঠায় সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ব্যবধান বাড়ছে। বর্তমানে তেঁতুলিয়ার আকাশে মেঘ নেই। এখন থেকে তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কমতে থাকবে। এতে দিন ও রাতের তাপমাত্রার ব্যবধানও কমবে।