গ্রামে বিলাসবহুল বাড়ি, খামার-বাগান, মসজিদ-মার্কেট কী করেননি আবেদ আলী
মাত্র আড়াই বছরে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নে ১০ একরের বেশি জমি কিনেছেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী (৬০)। প্রায় ১ একর জমির ওপর বানিয়েছেন তিন তলাবিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ি। বাড়ির পাশেই করেছেন মসজিদ, আমবাগান, গরুর খামার ও মার্কেট।
বালিগ্রাম ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত দুই বছরে আটিপাড়া, পান্তাপাড়া, পশ্চিম বোতলাসহ বিভিন্ন মৌজায় ১০ একরের বেশি ফসলি জমি কিনেছেন আবেদ আলী। বেশির ভাগ জমি তিনি নিজের নামে নামজারি করেছেন। এ ছাড়া স্ত্রী ও ছেলের নামেও জমি কিনেছেন।
ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা কবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখানে দুই বছর ধরে কাজ করছি। এ সময়ের মধ্যে আবেদ আলী নিজের নামে ৫ একরের মতো জমি নামজারি করেছেন। তিনি আগে-পরে আরও জমি কিনেছেন। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নামেও আলাদা জমি আছে।’
বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে আবেদ আলী, তাঁর ছেলে সোহানুর রহমানসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরপরই রাজধানীতে বাড়ি-গাড়ি, হোটেলসহ তাঁর বিপুল সম্পদের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
আলিশান বাড়ি ঘিরে মসজিদ-মার্কেট-খামার
ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে ডাসার উপজেলার ভাঙ্গাব্রিজ থেকে চার কিলোমিটার দূরে বালিগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বোতলা গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা আবেদ আলী। মঙ্গলবার দুপুরে আবেদ আলীর তিনতলা বিলাসবহুল বাড়ির সামনে গিয়ে প্রতিবেশীদের ভিড় দেখা গেল। বাড়ির চারপাশ সীমানাপ্রাচীর। বাড়ির সামনেই সৈয়দ আবেদ আলী কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ ও মসজিদ। পাশেই আমবাগান।
বাড়ি থেকে ৩০০ মিটার দূরে পশ্চিম বোতলা বাজার। সেখানে আবেদ আলীর নির্মাণাধীন মার্কেট ও গরুর খামার। কয়েক মাস আগে বাড়ির পেছনে প্রায় ৩০ শতাংশ জমি কিনেছেন আবেদ আলী। পাশের গ্রাম আটিপাড়া ও পান্তাপাড়ায় দুটি মৌজায় প্রায় ৭ একর ফসলি জমি কিনেছেন তিনি। যদিও সেখানে তাঁর নামে কোনো সাইনবোর্ড দেখা যায়নি।
আটিপাড়া গ্রামের আবদুস সাত্তার হাওলাদারের (৪৫) বাড়ির পাশে ২ একর জমি কিনেছেন আবেদ আলী। আবদুস সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ঘরের পাশে দুই দাগে ৬০ শতাংশ জমি কিনেছেন আবেদ আলী। তখন এক লাখ টাকা শতক ছিল। আটিপাড়া মৌজায় আরও অনেক জমি আছে তাঁর। এসব জমি তিনি দেড় বছর আগে কিনে রেখে দিছেন। সবই আবেদ আলী ও তাঁর ছেলের নামে কিনেছেন।’
পান্তাপাড়া এলাকার তুহিন হোসেন বলেন, আগে তাঁর জমি কেনার নেশা ছিল না। এখন এলাকায় কেউ জমি বিক্রি করলে আবেদ আলী কেনেন। পান্তাপাড়ায় তিনি ৩ একরের বেশি জমি কিনেছেন।
রাজনীতিতে আবেদ আলী
২০২১ সালে ২৬ জুলাই ডাসার উপজেলা ঘোষিত হওয়ার পরও আবেদ আলীকে স্থানীয় রাজনীতিতে দেখা যায়নি। ২০২৩ সালের শুরুতে তিনি হঠাৎই রাজনীতিতে সক্রিয় হন। নিজেকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা করে প্রতিটি গ্রামে দামি গাড়ি হাঁকিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিতে শুরু করেন। ঈদ, কোরবানিতে দান-দক্ষিণা করতে থাকেন। ছেলে ছাত্রলীগ নেতা (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সোহানুর রহমান তাঁর সঙ্গে থাকতেন। সোহানুর নিজেও আলাদা দামি গাড়ি ব্যবহার করতেন। এ সময় আবেদ আলীর সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ছিলেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বালিগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মতিন মোল্লার সঙ্গে আবেদ আলীর সখ্য ছিল। রাজনীতির মাঠে মতিন মোল্লার সহযোগিতায় তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন।
আজ আবেদ আলীর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা মতিন মোল্লার দেখা পাওয়া যায়। মতিন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, আবেদ আলীর পরিবারের সবাইকে তিনি চেনেন। তাঁরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ছিলেন না। আবেদ আলী ছোটবেলা থেকে ঢাকায় থাকতেন। সেখানেই তিনি চাকরি করতেন। পরে ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে হয়তো টাকার মালিক হয়েছেন। কত টাকার মালিক, তাঁর ধারণা নেই। স্থানীয় হিসেবে তাঁর সঙ্গে চেনাজানা ছিল। তবে তাঁর কোনো অপকর্মে তিনি বা তাঁরা জড়িত নন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবেদ আলী আমাদের সৈয়দ বংশের কেউ নন। তিনি একজন পাকা ড্রাইভার। তাঁর কখনোই দলীয় রাজনীতিতে পদ ছিল না। তৃণমূল রাজনীতিতে আবেদ আলীর কোনো ভূমিকা ছিল না। তিনি নিজেকে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে দাবি করে প্রচারণা চালাতেন। তাঁর সঙ্গে যাঁরা ঘুরতেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের দলীয় লোক নন, তাঁর ব্যক্তিগত লোকজন।’ তিনি বলেন, আবেদ আলীর বৈধ কোনো আয় ছিল না। তিনি অসৎ উপায়ে আয় করে এলাকায় দানবীর সেজেছেন। ঢাকার মিরপুর, শ্যামলী ও উত্তরায় একাধিক বাড়ি করেছেন। এসব অবৈধ আয়ে এলাকায় শোঅফ করেছেন।
‘দানবীর’ আবেদ আলী
পশ্চিম বোতলা গ্রামের সবাই আবেদ আলীকে ‘দানবীর’ হিসেবেই জানতেন। এলাকাবাসী জানতেন, আবেদ আলী ঢাকার বড় ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক। ঢাকায় তাঁর জমি, গাড়ির ব্যবসাসহ বিভিন্ন ব্যবসা আছে। ১০ বছর আগে তিনি সরকারি গাড়ি চালাতেন, সেটাও তাঁরা জানতেন। তিনি সরকারি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রে জড়িত, তাঁরা জানতেন না। তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেটিও অনেকে বিশ্বাস করেন না। পশ্চিম বোতলা গ্রামের বাসিন্দাদের ভাষ্য, উপজেলা নির্বাচন করাকে কেন্দ্র করে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে।
বোতলা এলাকার কৃষক হানিফ ব্যাপারী বলেন, ‘আমাদের এলাকার ভালো মানুষ হিসেবেই আমরা তাঁকে (আবেদ) চিনি। আগে চাকরি করতেন, এখন অনেক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এলাকায় দান করে, গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে থাকেন। তাঁর কাছে যে–ই যায়, কাউকে তিনি ফেরান না।’
আবেদ আলীর প্রতিবেশী আবদুল আলীম বলেন, ‘আমরা তাঁকে বড় ব্যবসায়ী হিসেবে চিনি। গ্রামের বাড়িতে এলে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন, কাউকে না করতেন না। শুনতেছি, তিনি ঢাকায় অবৈধ পথে আয় করতেন, তবে এলাকার মানুষের সঙ্গে তিনি কখনো কোনো প্রতারণা করেননি।’
পদবি পাল্টে হয়েছেন সৈয়দ
পশ্চিম বোতলা গ্রামে সৈয়দ বংশের কোনো বাড়ি নেই। সেখানে মীর বংশের ছয়টি পরিবার থাকে। আবেদ আলী মীর বংশের ছেলে। অর্থবিত্তের সঙ্গে তিনি মীর পদবি পাল্টে নামের আগে সৈয়দ পদবি ব্যবহার শুরু করেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, পশ্চিম বোতলা গ্রামের মৃত আবদুর রহমান মীরের ছেলে আবেদ আলী। তাঁর আরও দুজন ভাই আছেন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে আবেদ দ্বিতীয়। তাঁর বড় ভাই জাবেদ মীর কৃষিকাজ করেন। ছোট ভাই সাবেদ মীর সৌদিপ্রবাসী হলেও এক বছর ধরে তিনি এলাকায় জমিজমা দেখভাল করেন। বড় ও ছোট দুই ভাইয়ের দুই ছেলে ইতালিতে থাকেন। আবেদ আলীর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মীর বংশের একজন হয়েও আবেদ আলীর পরিবারের সব সদস্য নামের আগে সৈয়দ ব্যবহার করেন।
নামের আগে সৈয়দ ব্যবহার করে আবেদ আলী প্রতারণা করতেন বলেও অভিযোগ আছে। ডাসার বাজার এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ রাকিব হোসেন বলেন, আবেদ আলী নিজের নামের সঙ্গে সৈয়দ যুক্ত করে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বংশের লোক বলে দাবি করতেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন মহলে নিজের সুবিধা বাগিয়ে নিতেন।