সরকার পতনের দিন বাড়িতে আগুন, ২৭ দিনেও ফিরতে পারেনি পরিবারটি

অগ্নিসংযোগের পর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বাড়িটি। ঘটনার পর মালিক বাড়িছাড়া। আজ রোববার সকালে যশোর শহরের লোন অফিসপাড়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন গত ৫ আগস্ট যশোর শহরের লোন অফিসপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামের বাড়িতে হামলা করে একদল দুর্বৃত্ত। লাঠিসোঁটা নিয়ে ২০ থেকে ৩০ জন বাড়ির প্রধান ফটক ভেঙে নিচতলা গ্যারেজে রাখা কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। হইচই শুনে নিচে নেমে আসেন বাড়ির দোতলার ভাড়াটিয়া সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ফিরোজ আহম্মেদ (৩৫)। আতঙ্কে সেখানে তিনি মারা যান।

ঘটনার পর প্রাণের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান মালিক রফিকুল ইসলাম। ২৭ দিন ধরে পরিবার নিয়ে তিনি নিজের বাড়িতে ফিরতে পারছেন না। ২১ আগস্ট রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে যশোর কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় শহরের মনিহার প্রেক্ষাগৃহ এলাকার আবাসিক হোটেল কোকোর মালিক মহব্বত আলী (টুটুল) ও তাঁর দুই কর্মচারীসহ ছয়জনের নাম–পরিচয় উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা ৩০ থেকে ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ছবি ও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তারিকুল ইসলাম ইতিমধ্যে ওই বাড়িতে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি ও আলামত সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ রফিকুল ইসলামের।

রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী নই। কখনো কোনো দলের মিছিল-মিটিংয়ে যাইনি। ঠিকাদারি ব্যবসা করি। শুধু ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে মহব্বত আলী লোকজন দিয়ে আমার বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করিয়েছেন। মামলা করায় অব্যাহতভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। পরিবার নিয়ে প্রাণভয়ে নিজের বাড়িতে ফিরতে সাহস পাচ্ছি না। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও ছবি পুলিশকে দিয়েছি। কিন্তু ২৭ দিনেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি।’

এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রাজ্জাক বলেন, মামলা হয়েছে ঘটনার ১৬ দিন পর। ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ পেয়েছেন। যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মহব্বত আলী আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন বলে শুনেছেন।

অভিযুক্ত মহব্বত আলী বলেন, রফিকুলের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তাঁর (রফিকুল) সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল। তিনি প্রতারণার মাধ্যমে তাঁর কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ বিষয়ে থানায় মামলা আছে। ওই টাকা যাতে না দেওয়া লাগে, সে জন্য তিনি মামলা করেছেন।

আজ রোবাবার সকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, চারতলা বাড়িটির নিচতলার গ্যারেজে রাখা একটি প্রাইভেট কার, একটি জিপ ও ছয়টি মোটরসাইকেল পুড়ে গেছে। নিচতলায় ব্যবসায়িক কার্যালয়ের আসবাবসহ পোড়ানো মালামাল ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। দুটি নষ্ট রেফ্রিজারেটর। দোতলা ও তিনতলার সিঁড়িতেও আগুনের কালো ছাপ দেখা যায়।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, বাড়ির প্রধান ফটক খুলে ২০ থেকে ৩০ জন লাঠিসোঁটা নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গ্যারেজে রাখা গাড়ি ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করছে। অন্যান্য আসবাব তছনছ করছে। দীর্ঘক্ষণ ধরে ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

বাড়ির দোতলায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাড়া থাকতেন পিআইও ফিরোজ আহম্মেদ। হামলার সময় তাঁরা বাড়িতে ছিলেন। হইচই শুনে নিচে নেমে দেখেন আগুন জ্বলছে। আগুনের কালো ধোয়া তাঁর নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢোকে। এ সময় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তিনি মারা যান। ঘটনার সময় ফিরোজের স্ত্রী তাসনিম সুলতানা, তাঁর সাত বছরের মেয়ে মারিয়াম সুলতানা ও সাত মাসের ছেলে বাসায় ছিল।

তাসনিম সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিনের সন্ধ্যাটা ছিল বিভীষিকাময়। নিচে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। ওপরে আমরা। সিঁড়ি দিয়ে আগুন ওপরে ওঠে আসছে। আমরা কেউ বাঁচব—আশা ছিল না। ঘরে ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়ে। আমাদের বাঁচাতে মরিয়া ওঠে ওঠে আমার স্বামী। ভয়ে-আতঙ্কে মারা যান। মেয়েটির বয়স সাত বছর। সে প্রতিদিনই বাবাকে খুঁজছে। শুধু বলছে, “বাবাকে এনে দাও, বাবার সাথে বেড়াতে যাব”। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না।’