‘এহন আমি কীবায় চার সন্তান লইয়া চলবাম’
৫ আগস্ট সকাল নয়টায় ঢাকার সাভারের আশুলিয়া এলাকার ভাড়া বাসা থেকে বের হন সাব্বির ইসলাম (৪৪)। উদ্দেশ্য ছিল দিনমজুরি করে চাল-ডালসহ বাজার সদাই নিয়ে ঘরে ফেরার। কিন্তু তা আর হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
নিহত সাব্বির ইসলাম নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার লুনেশ্বর ইউনিয়নের খিলা বাউন্দি গ্রামের মৃত শুকুর আলীর ছেলে। উপজেলার বানিয়াজান এলাকায় তাঁর পরিবারের লোকজন বাস করে। তাঁর তিন মেয়ে ও এক ছেলে। ১২ বছর বয়সী ছেলে মো. মমিন মিয়া বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। বড় মেয়ে লিজা আক্তার (১৫) চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে টাকার অভাবে আর পড়তে পারেনি। অভাবের সংসার কোনোমতে চলছিল। এরই মধ্যে একমাত্র উপার্জনক্ষম সাব্বিরের মৃত্যুতে পরিবারটি পথে বসে গেছে।
গত শনিবার বিকেলে আটপাড়া উপজেলার বানিয়াজান এলাকায় নিহত সাব্বির ইসলামের বাড়িতে গিয়ে বিষণ্ন দেখা যায় তাঁর স্ত্রী ফরিদা আক্তারকে। কথা বলার একপর্যায়ে আহাজারি করে ফরিদা বলেন, ‘এহন আমি কীবায় চার সন্তান লইয়া চলবাম? আমার তো সবই শেষ হইয়া গেছে। ছেড়াডাও (ছেলেটিও) প্রতিবন্ধী, মেয়েডাও বড় হইছে বিয়া দিতে হইব। আমার মাথায় কিছুই ধরে না।’
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাব্বির ইসলাম প্রায় দুই দশক আগে বানিয়াজান গ্রামের জামাল উদ্দিনের মেয়ে ফরিদা আক্তারকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি শ্বশুরবাড়ি এলাকায় চলে যান। তাঁর শ্বশুরও দরিদ্র। সেখানে কুঁড়েঘরে বসবাসের পাশাপাশি দিন মজুরিসহ বিভিন্ন কাজ করে জীবিকানির্বাহ করেন সাব্বির। কিন্তু বছর সাতেক আগে সেই কুঁড়েঘরটিও ভেঙে পড়ে। জীবিকার তাগিদে ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় গিয়ে একটি শর্ষের তেলের কারখানায় কাজ নেন তিনি। সেখানে স্ত্রী, আর চার সন্তান নিয়ে কোনো রকমে সংসার চলছিল তাঁর। গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়েন সাব্বির। ৫ আগস্ট সকালে কাজের সন্ধানে বাসা থেকে বের হন তিনি। দিনমজুরি শেষে বাজার সদাই নিয়ে ঘরে ফেরার কথা ছিল তাঁর। পরিস্থিতি দেখে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। আন্দোলন সংঘর্ষ চলাকালে বেলা ১১টার দিকে সাভারের বাইপাইল এলাকায় তাঁর ডান কানের পাশ দিয়ে একটি গুলি ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সাব্বিরকে হারিয়ে দিশেহারা তাঁর স্ত্রী ফরিদা আক্তার।
ফরিদা বলেন, ‘আন্দোলন শুরু হওয়ার কারণে কারখানা বন্ধ হইয়া যায়। কাজকাম না থাহনে ধারদেনা কইরা চলছি। পোলাপান ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করছিল। শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি আর সংসারে অভাব দেইখ্খা আমার স্বামী আন্দোলনে যোগ দেয়। ৫ তারিখ ঘর থাইক্কা বাইর হওনের সময় কইছিল, “বাজার-সদাই লইয়া আইমু। কাম না পাইলে ছাত্রদের লগে আন্দোলনে গিয়া সরকার পতন ঘটাইয়া ঘরে ফিরমু।” কিন্তু সরকার পতন ঠিকই হইল, আমার স্বামী তো আর ফিরল না। পোলাপান নিয়া আমি অহন কীভাবে চলবাম? যারা আমার স্বামীরে মারল, তাদের বিচার আল্লাহর কাছেই দিলাম।’
ফরিদা আক্তারের ভাই মো. চঞ্চল মিয়া বলেন, গুলিতে নিহত সাব্বির রাস্তায় পড়ে ছিলেন। একজন সাব্বিরের ফোন থেকে ফরিদাকে বিষয়টি জানান। পরে তাঁরা একটি পিকআপ ভ্যানে করে লাশ আটপাড়ার বানিয়াজান গ্রামে নিয়ে ফেরেন রাত পৌনে চারটায়। ৬ আগস্ট জানাজা শেষে দুপুর ১২টায় তাঁর লাশ দাফন করা হয়।
প্রতিবেশী চুন্নু খান বলেন, সাব্বির খুবই নিরীহ ও ভালো মানুষ ছিলেন। আন্দোলনে গিয়ে নিহত হওয়ায় তাঁর পরিবার এখন খুবই বিপদে পড়েছে। সরকার ও বিত্তবানরা সহযোগিতার হাত বাড়ালে বাচ্চাদের নিয়ে সাব্বিরের স্ত্রী ফরিদা ভালোভাবে বাঁচতে পারতেন।
এ বিষয়ে আজ সোমবার সকালে মুঠোফোনে আটপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম সাজ্জাদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত শ্রমিক সাব্বির ইসলামের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকার চেক দেওয়া হবে। এ ছাড়া পরিবারটিকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।