মাদক সেবনে নাকি হত্যার শিকার, কুমিল্লায় দুই যুবকের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা
কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ এলাকার একটি নির্জন বিল থেকে দুই যুবকের মরদেহ উদ্ধারের পর মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। পুলিশ বলছে, বিষাক্ত কোনো মাদকদ্রব্য সেবনের কারণে এই দুজনের মৃত্যু হতে পারে। আর ওই যুবকদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। তাঁরা এর সঠিক তদন্ত চান।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, জাফরগঞ্জ বাজার এলাকাটি দেবীদ্বার উপজেলার মধ্যে মাদক কারবার ও সেবনের ‘হটস্পট’ হিসেবে পরিচিত। তবে যেই নির্জন স্থান থেকে তাঁদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ঘটনার সময় সেখানে আরও লোকজন ছিলেন।
গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার জাফরগঞ্জ এলাকার দোয়াইজলা নামের বিলটিতে খালের পাড়ের একটি নির্জন স্থান থেকে দুই যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহ উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থল থেকে মাদক সেবনের বিভিন্ন আলামত পাওয়া যায়। তবে তাঁদের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি।
ওই যুবকেরা হলেন উপজেলার জাফরগঞ্জ গ্রামের মনির হোসেন (৩০) ও খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার সুখাকেন্দ্রায় গ্রামের মোহন মিয়া (২৮)। তাঁরা দুজনই জাফরগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী বদিউল আলমের প্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট লাইন সংযোগ, মেরামত ও ডিশের বিল উত্তোলনের কাজ করতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় তিনজন ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, দেবীদ্বার উপজেলার মধ্যে জাফরগঞ্জ এলাকায় মাদকের ভয়াবহতা বেশি। প্রায়ই বিলটিসহ বিভিন্ন নির্জন স্থানে মাদকের আসর বসে। গতকাল মরদেহ উদ্ধার হওয়া দুই যুবকও মাদক সেবন করতেন। পুলিশ ভালোভাবে তদন্ত করলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।
দেবীদ্বার থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শাহিনুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। পারিপার্শ্বিক আলামত বিশ্লেষণের পর প্রাথমিকভাবে বলা যাচ্ছে, ওই দুই যুবকের মৃত্যুর নেপথ্যের কারণ মাদক। তবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে আসার পরই বিষয়টি নিশ্চিতভাবে বলা যাবে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন এতটুকুই বলতে পারি, তারা কোনো একটা নেশাজাতীয় দ্রব্য খেয়েছে। তবে সেটা কী ছিল, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনই সবকিছু পরিষ্কার হওয়া যাবে।’
মনির হোসেনের মা–বাবা বেঁচে নেই। তাঁর তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বোনেরা শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। স্ত্রী রেশমা আক্তার, সাড়ে তিন বছরের ছেলে ইব্রাহিম এবং এক বছর বয়সী মেয়ে মনিরা আক্তারকে নিয়ে তাঁর টানাটানির সংসার। মনিরের সামান্য আয়ে কোনোরকমে চলত পরিবারটি। স্বামীর এমন মৃত্যুতে ২২ বছর বয়সী রেশমা এখন দিশাহারা। কী করবেন ভেবে কূল পাচ্ছেন না। ঘটনার পর থেকেই স্বামীর জন্য বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি।
স্ত্রী রেশমা আক্তার বলেন, ‘আমি এহন কিতা করতাম? কেমনে বাইচ্চাম পোলাপানডিরে লইয়া? আমার তো সব শেষ হইয়া গেল। আমার পোলা-মাইয়া এহন কারে আব্বা কইব? এই বয়সে আল্লাহ আমারে বিধবা বানাইল, পোলাপানডিরে এতিম করল।’
রেশমা আক্তার বলেন, তাঁর স্বামী গত শনিবার দুপুরের খাবার খেয়ে ঘর থেকে বের হন। এরপর আর ফিরে আসেননি। সন্ধ্যার পর কাঁচাবাজার অন্য লোকের মাধ্যমে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ভেবেছিলেন কাজ বেশি থাকায় কর্মস্থলে রাতে থেকে গেছেন। গতকাল সকালে আবু কাউছার নামের এক যুবক গরুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়ে মনিরদের বাড়ির থেকে প্রায় পাঁচ শ গজ দূরে বিলের মধ্যে নির্জন খালপাড়ে তাঁদের মরদেহ দেখে চিৎকার করেন। পরে তাঁরা গিয়ে দেখেন এ দুজনের নিথর দেহ পড়ে আছে।
মারা যাওয়া মোহন মিয়ার বাবা রুহুল আমিন রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। রুহুল আমিনের আট সন্তানের মধ্যে মোহন ষষ্ঠ। এখনো বিয়ে করেননি। কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেকে বিয়ে করাতে চেয়েছিলেন রুহুল আমিন।
গতকাল রাত ১১টার দিকে মুঠোফোনে রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলেটা ভালো আছিল। কখনো তাঁকে নেশা করতে দেখিনি। আমার ছেলেটার এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমার ছেলে কীভাবে নেশা করে মরতে পারে?’
জাফরগঞ্জ বাজারের ডিশ ও ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক বদিউল আলম বলেন, ‘মনির, মোহনসহ ১২ জন স্টাফ আমার সঙ্গে কাজ করেন। মনির রাতে তাঁর বাড়িতে থাকত আর মোহন আমার অফিসে। শুনেছি শনিবার রাতে মনির অফিস থেকে মোহনকে ডেকে নিয়ে গেছেন। মনির মাঝেমধ্যে নেশাজাতীয় কিছু খেতেন, এটা শুনেছি। তবে মোহন নেশা করতেন কি না, আমি জানি না।’
পুলিশ পরিদর্শক শাহিনুল ইসলাম বলেন, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষার বাইরেও পুলিশ ঘটনাটির তদন্ত করছে। ঘটনাস্থলে আরও কেউ ছিলেন কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদি অন্য কোনো কারণ থাকে, সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।