‘জীবন মানে কষ্ট ভেবেই রাত-দিন কাজ করি’
ঘড়িতে তখন মঙ্গলবার রাত ৯টা ৫৯ মিনিট। পৌষের কনকনে ঠান্ডা। তার মধ্যে খোলা আকাশের নিচে ফুটপাতে বসে একদল নারী শাক কুটে যাচ্ছেন। এত মিহি করে শাক কাটছেন তাঁরা, দাঁড়িয়ে দেখছেন অনেকে। রাজশাহী নগরের সিঅ্যান্ডবি মোড়ে ফুটপাতে দৈনিক রাতে এই নারীরা শাক আর বঁটি নিয়ে বসেন। ক্রেতাদের সুবিধার্থে এই নারীরা শাক কুটে দেন। এ থেকে যে আয় হয়, তা সংসারে খরচ করেন।
কথা বলে জানা গেল, ছয়-সাত বছর ধরে ৮-১০ জন নারী এই ফুটপাতে বসে শাক কুটে বিক্রি করেন। তাঁদের সবার বাড়ি নগরের শ্রীরামপুর এলাকায়। হতদরিদ্র পরিবারের এই গৃহবধূরা সংসার খরচ জোগাড় করতে না পেরে এই পথ বেছে নিয়েছেন। তাঁরা সকাল সাড়ে আটটায় নৌকায় করে পদ্মা নদী পার হয়ে চরের মাঠে যান। জমির মালিককে টাকা দিয়ে নিজেরাই শাক তুলে আনেন। তাঁদের কাছে আছে খেসারি, ছোলা ও বথুয়া শাক। একেকজন প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৬ কেজি পর্যন্ত শাক তোলেন। আবার নদী পার হয়ে বাড়িতে এসে শাক ধুয়ে পরিপাটি করে বেলা তিনটার দিকে ফুটপাতে এসে বসেন। যখন শীত বেড়ে যায়, ক্রেতা কমে যায়। বিক্রি শেষ হতে দেরি হয়। কোনো কোনো দিন রাত একটাও বেজে যায়। তাঁরা ফুটপাতে এই শাকসবজি নিয়ে বসে থাকেন। এখন প্রতি কেজি খেসারির শাক ১৪০ টাকা কেজি এবং ছোলার শাক ১৬০ টাকা কেজি। কেটে নিলে আরও কেজি প্রতি ২০ টাকা বেশি দিতে হয়।
জানা গেল, কেটে শাকসবজি বিক্রির বিষয়টি এখানে প্রথম শুরু করেছিলেন শ্রীরামপুর মহল্লার মলি বেগম নামের এক গৃহবধূ। তিনি প্রথম দিকে মাঠ থেকে শাক নিয়ে এসে বিক্রি করতেন। একদিন এক বয়স্ক লোক বলেন, বাড়িতে তাঁর শাক কেটে দেওয়ার কোনো মানুষ নেই। কেটে দিলে তিনি কিনতে পারেন। সেই থেকে মলি শাকসবজি কুটে দেওয়া শুরু করেন। তাঁর ভালো ব্যবসা হচ্ছে দেখে ওই মহল্লার ৮ থেকে ১০ জন নারী এখন এভাবে কেটে শাকসবজি বিক্রি করাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।
কথা হয় পলি খাতুনের সঙ্গে। তিনি খেসারি, ছোলা ও বথুয়ার শাক বিক্রি করছেন। যে কয় মাস মাঠে থাকে, তিনি সেই কয় মাস মাঠ থেকে শাক নিয়ে এসে তিনি বিক্রি করেন। তিনি বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে মাঠে যেতে হয়। আবার নৌকায় পদ্মা নদী পার হয়ে বাড়িতে এসে সেই শাক পরিষ্কার করে ফুটপাতে নিয়ে বসতে হয়। এটা কঠিন পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু উপায় নেই। সংসারে একটু সচ্ছলতা বাড়াতে তাঁদের এই কাজ করতেই হয়। তাঁর স্বামী একজন দিনমজুর। একজনের রোজগারে সংসার ঠিকমতো চলতে চায় না। সব জিনিসের দাম বেশি। এসব খরচ মিটিয়ে সন্তানের পড়ালেখার খরচ দিতে হয়। এ জন্য তিনি বাড়তি কাজ করেন, যাতে সংসার চালানোর জন্য স্বামীর হাতে টাকাটা তুলে দিতে পারেন।
পলির আপন বোন রিমা খাতুন তাঁর পাশে বসেই শাক কাটছিলেন। তিনি বলেন, ‘জীবন মানে কষ্ট ভেবেই রাত–দিন কাজ করি। স্বামী নির্মাণশ্রমিকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। সপ্তাহে দুই দিন কাজ করেন, তো তিন দিন শুয়ে থাকেন। সংসার খরচের চিন্তা তাঁর নাই। দুইটা ছেলে–মেয়ে। শাকের মৌসুম শেষ হলে পেঁয়াজু-পুরির দোকান নিয়ে বসেন।’
যাঁর হাত ধরে এখানে কেটেকুটে শাক বিক্রি শুরু, সেই মলি বেগম বলেন, তিনি একা শুরু করেছিলেন। এখন ১০-১২ জন মিলে এই ফুটপাতে শাক কুটে বিক্রি করেন। তিনি চান, আরও মেয়েরা এই কাজে আসুক। আরও বেশি মানুষ শাকসবজি কিনুক। স্বামী–স্ত্রী দুজন মিলেই সংসার চালাতেন। দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর তাঁর স্বামী আর কোনো কাজ করতে পারেন না। সংসারের দায়িত্ব তাঁকে একাই বহন করতে হয়। এক শাকের মৌসুম শেষ হলে আরেক শাক নিয়ে বসেন।
আধা কেজি খেসারি শাক কিনেছেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক রাশিদা বেগম। তিনি বলেন, এই নারীরা এত মিহি করে শাক কুটে দেন, খুব ভালো লাগে। তাই তিনি কেনেন।