নিয়মিত বিল দিয়েও পানি পান না নোয়াখালীর চৌমুহনী পৌরসভার বাসিন্দারা
প্রতি মাসেই ৬৫০ টাকা করে পানির বিল দিচ্ছেন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যম করিমপুর এলাকার বাসিন্দা আবু তাহের (৬৫)। কিন্তু পানির লাইনে এক ফোঁটা পানিও আসে না। বেশি পরিমাণে পানি পাওয়ার আশায় মোটা পাইপের সংযোগও নিয়েছেন, তাতেও পানি আসে না। লিখিত অভিযোগ করেছেন পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে, কোনো কাজ হয়নি। বাধ্য হয়ে কখনো বাজার থেকে, কখনো অন্যের বাসা থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করেন। আর গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করছেন পাশের পুকুরের ময়লা পানি। এতে করে পরিবারের সদস্যদের অসুখবিসুখ লেগেই আছে।
শুধু আবু তাহেরই নন, একই ভোগান্তির শিকার মধ্যম করিমপুর এলাকার বেশির ভাগ বাসিন্দা। আবু তাহেরের বাড়ি লুতু মিয়ার বাড়ি হিসেবে পরিচিত। ওই বাড়িতে পৌরসভার পানির সংযোগ আছে পাঁচটি। কোনো সংযোগেই পানি আসে না। পাশের মান্নান ভূঁইয়ার বাড়িতে দেখা যায়, পৌরসভার পানির লাইন পড়ে আছে অরক্ষিত, ঘরের বাইরে। গৃহিণী সানজিদা আক্তার বলেন, তাঁরা পানি পান না প্রায় চার মাস ধরে। পাশের এক বাড়ি থেকে পানি এনে পান করেন। গত বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চৌমুহনী পৌরসভার করিমপুর ও আশপাশের এলাকায় ঘুরে গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে পানির কষ্টের একই তথ্য পাওয়া যায়।
পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, দুই হাতে দুই বালতিভর্তি পানি নিয়ে বাড়িতে ফিরছেন এক ব্যক্তি, নাম মো. দুলাল (৫২)। তিনি বলেন, বাড়িতে পৌরসভার পানির লাইনে পানি আসে না অনেক দিন। বাধ্য হয়ে ভাত-তরকারি রান্নার জন্য দূরের এক বাড়ির পুকুর থেকে পানি নিচ্ছেন। খাবার পানি পান করেন বাজার থেকে কিনে। মাঝেমধ্যে আশপাশের যাঁদের লাইনে পানি আসে, তাঁদের কাছ থেকে পানি সংগ্রহ করেন। গোসল করতে হয় বাড়িতে বসানো বৈদ্যুতিক পাম্পের পানি দিয়ে। সেগুলো অতিমাত্রায় লবণাক্ত হওয়ায় মুখেও নেওয়া যায় না।
পানি সরবরাহ শাখা থেকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চৌমুহনী পৌরসভার পানি সরবরাহের মোট লাইন ১২৪ দশমিক ২ কিলোমিটার। পানি সরবরাহের সক্ষমতা ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার লিটার। পানি উত্তোলনের জন্য বিভিন্ন এলাকায় ১৫টি পাম্প বসানো হয়েছে। এসব পাম্পের মাধ্যমে উত্তোলিত পানি নেওয়া হয় কলেজ রোড, হাজীপুর ও চৌরাস্তা এলাকার তিনটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে। সেখানে পানি থেকে লোহা দূরীকরণের পর তা পাইপলাইনে গ্রাহকদের মধ্যে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হয়, তা দিয়ে পৌরসভার চাহিদার মাত্র ৬৫ শতাংশ মেটানো সম্ভব হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পৌরসভার একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পানি সরবরাহের যেটুকু সামর্থ্য পৌরসভার রয়েছে, সেটুকুও যথাযথভাবে কাজে লাগানো হয় না। তা ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে পাইপলাইন বসানোর কারণে কোনো এলাকার গ্রাহক পানি পান, কোনো এলাকায় মোটেই পানি পাওয়া যায় না। আবার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মূল পাইপলাইনের সঙ্গে অবৈধভাবে পাম্পের সংযোগ দিয়ে সরাসরি পানি তুলে নেন। এতে সাধারণ গ্রাহকের কাছে আর পানি পৌঁছায় না। অবৈধ ওই সব সংযোগের সঙ্গে পৌরসভার লোকজনও জড়িত, আর ভুগতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই পুকুর ছিল, পানিও ভালো ছিল। এখন অনেক পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। যেগুলো আছে, সেগুলোর পানি ব্যবহার করার মতো নয়। তবু উপায় না দেখে ওই দূষিত পানি দিয়ে ঘরের কাজ করছেন বলে জানান পৌরসভার বাসিন্দা সাজেদা আক্তার। তিনি বলেন, চৌমুহনী এলাকার পাতালের (ভূগর্ভের) পানিতে অতিরিক্ত লবণ। বাসাবাড়িতে পাম্প বসিয়ে ওই পানি তোলা হলেও তা খাওয়ার কাজে ব্যবহার করা যায় না। খাওয়ার জন্য পানি কিনতে হচ্ছে এখন।
পৌরসভার পানি শাখার সহকারী প্রকৌশলী মিনহাজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পানি সরবরাহে সমস্যা কমবেশি সব সময় থাকে। পানি সরবরাহ বাড়াতে এই মুহূর্তে নতুন কোনো প্রকল্প নেই। সরবরাহ লাইনে লিকেজের কারণে অনেক সময় কোনো কোনো লাইনে পানি সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। এ কারণে ওই সব এলাকায় পানির সরবরাহে সমস্যা হয়। তবে মধ্যম করিমপুর এলাকায় পাইপলাইনে পানি যাওয়ার আগেই যাঁরা মূল পাইপ লাইনের কাছাকাছি আছেন, তাঁরা অবৈধ পাম্প দিয়ে পানি টেনে নিয়ে যান। এতে দূরের গ্রাহকেরা পানি কম পান। তবে পাঁচ-সাত বছর ধরে পানি না পাওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। পানি না পেলে তাঁরা বিল কেন দেবেন? লাইন কেটে দিলেই তো পারেন।
বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পৌরসভার পানি সরবরাহে সমস্যা নিয়ে তিনি এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীসহ পৌরসভার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা অবৈধ পাম্প দিয়ে পানি টেনে নিয়ে যাওয়াই পানিসংকটের অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে শিগগিরই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।