শীতলপাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় হরেন্দ্র কুমারেরা
শীতলপাটির বুননের সূত্র ধরেই দেশ-বিদেশে ঘুরেছেন হরেন্দ্র কুমার দাস। কুড়িয়েছেন প্রশংসা। শীতলপাটির কারু–সৌন্দর্যে যেন তাঁর জীবনটাই মোড়ানো। তবে সেই সুনাম-ঐতিহ্য ধরে রাখা নিয়ে চরম উদ্বেগে আছেন অভিজ্ঞ এই কারুশিল্পী। বিলুপ্তপ্রায় শীতলপাটির ঐতিহ্য ধরে রাখতে যে পুঁজির প্রয়োজন, সেটি তাঁর কাছে নেই। তাই পুঁজির সংকটে অচল হতে বসেছে তাঁর শীতলপাটি বোনার উদ্যম।
হরেন্দ্র কুমারের বাড়ি মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের ধুলিজোড়া গ্রামে। শীতলপাটির জন্য এই গ্রামের সুনাম দীর্ঘদিনের। একটা সময় ধুলিজোড়ার প্রায় শতভাগ পরিবারের মানুষ বংশপরম্পরায় শীতলপাটি বুনতেন। তবে এই গ্রামে শীতলপাটির সুদিন আর নেই। শীতলপাটি কারিগরদের অনেকেই এখন পেশা বদলে ফেলেছেন। অথচ শীতলপাটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ২০১৭ সালে সারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় শীতলপাটিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো।
সম্প্রতি ধুলিজোড়া গ্রামে দেখা হয় হরেন্দ্র কুমার দাসের সঙ্গে। জানালেন, ৪০ বছর ধরে তিনি শীতলপাটি বোনার সঙ্গে জড়িত। ছোটবেলায় বাবার কাছে শীতলপাটি বোনার কাজটি শিখেছিলেন। এই কাজের সূত্রেই শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সংস্থার মেলায় তিনি নিজের তৈরি শীতলপাটি নিয়ে হাজির হয়েছেন। ঘুরেছেন জাপান, কোরিয়া, নেপাল, হংকং ও শ্রীলঙ্কা। এসব দেশে শীতলপাটি সুনাম কুড়িয়েছে, মানুষের প্রশংসা পেয়েছেন। কিন্তু শীতলপাটির এই ঐতিহ্য এখন প্রায় বিলুপ্তির দিকে। কাঁচামালের সংকট, সঠিক বাজার মূল্য না পাওয়া ও আর্থিক সংকটে এই শিল্প ক্রমাগত বিলুপ্ত হওয়ার পথে বলে জানালেন তিনি।
তবে ধুলিজোড়া গ্রামে হরেন্দ্র কুমারের মতো গোপাল দাস, গোবিন্দ দাস, প্রমেশ দাস, দ্বিজেন্দ্র দাসসহ গুটিকয়েক মানুষ এখনো চেষ্টা করছেন এই শিল্পকে ধরে রাখতে। তবে এই চেষ্টায় বড় বাধা হয়ে আছে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব।
হরেন্দ্র কুমার দাস বলেন, ‘এখন এই কাজে আর পোষায় না। একটা শীতলপাটি বানাতে যে সময় লাগে, কাঁচামাল লাগে, সেই অনুযায়ী দাম পাওয়া যায় না। শীতলপাটি বুনতে মূর্তা বেত লাগে, সেটার সংকট আছে। রং, ডেকচি সবকিছুর দাম বেড়েছে।’
শীতলপাটির কারিগরেরা জানান, একটি সাধারণ শীতলপাটি বুনতে একজন কারিগরের প্রায় ১৫ দিন সময় লাগে। পাটি বিক্রি করে তিন থেকে চার হাজার টাকা পাওয়া যায়। অন্যদিকে নকশাওয়ালা শীতলপাটি বুনতে সময় লাগে প্রায় এক মাস। এ রকম শীতলপাটি ৭ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। কারুকাজের ওপর দাম নির্ভর করে। বর্তমানে ঢাকায় শীতলপাটির কিছুটা চাহিদা আছে। তবে তা দিয়ে পোষানো যায় না বলে দাবি করেন তাঁরা।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, প্রায় ২৫ বছর আগে প্রতি সপ্তাহে এই গ্রামে অন্তত ১০০ শীতলপাটি তৈরি হতো। তবে এখন সংখ্যার হিসাব দেওয়া কঠিন। কারণ, এখন যাঁরা শীতলপাটি বুনছেন, তাঁরা কেউই নিয়মিত না। পুরোনো কারিগরের অনেকেই মারা গেছেন। খরচ ও মজুরি অনুপাতে প্রকৃত দাম না পাওয়ায় নতুন প্রজন্ম আর এই কাজ শিখতে আগ্রহী নয়। আগে বিয়েশাদিতে শীতলপাটি একটি অপরিহার্য উপাদান ছিল। এখন আর সেটা লাগে না। এখন শীতলপাটির ব্যবহার শখের পর্যায়ে চলে গেছে। এ ছাড়া শীতলপাটির প্রধান উপাদান হচ্ছে মূর্তা বেত। আগে বেতের প্রাচুর্য ছিল। জলাভূমির আশপাশে প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর মূর্তা জন্মাত। স্থানীয় লোকজন নিজেরাও চাষ করতেন। তবে বেত সহজলভ্য নয়। সব মিলিয়ে শীতলপাটির উৎপাদন দিন দিন কমেই চলেছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) মৌলভীবাজার কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, একসময় মৌলভীবাজারের বড়লেখা, জুড়ী, রাজনগর ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে শীতলপাটি বোনা হতো। তবে এখন বিচ্ছিন্নভাবে দুই–একটি গ্রাম ছাড়া বেশির ভাগ গ্রামেই আর শীতলপাটি বোনা হয় না।
তবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আবার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন হরেন্দ্র কুমার দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজ (শীতলপাটি তৈরি) প্রায় অচল হওয়ার মতো। পুঁজি পাইতেছি না। পুঁজি না পাইলে কাজ বাদ দিতে হবে। পুঁজি পাইলে এখন যারা কাজ করে, তাদের সক্রিয় রাখা যাবে। দুই লাখ টাকা হলেই কাজটাকে সচল রাখতে পারতাম।’
গত ২১ মার্চ বিসিক মৌলভীবাজারের উপব্যবস্থাপক বিল্লাল হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশিক্ষণসহ কিছু ঋণের ব্যবস্থা আমাদের আছে। এ রকম শিল্পের জন্য আমরা ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ হিসেবে দিতে পারি, যা কিস্তিতে পরিশোধ করা যায়। কারিগরেরা যদি আসেন, আবেদন করেন তাহলে সরেজমিন দেখে তাঁদেরকে ঋণ দেওয়া যেতে পারে।’