তিন পাশে মেঘনা নদী এবং এক পাশে বঙ্গোপসাগরবেষ্টিত ঢালচর ইউনিয়ন এমনিতেই ভাঙনকবলিত। এর ওপর আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। ২৭ মে জোয়ার–জলোচ্ছ্বাসে ইউনিয়নের ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের সড়কে গলাসমান পানি ওঠে। সেই পানির তোড়ে আবদুল জলিলের ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। তিনি জানান, ঘরের মালামাল, হাড়িপাতিল, মুরগির খোপ, হাঁস, দুটি ছাগল ভেসে গেছে। ঘরে গলাসমান পানি ওঠার পর তিনি সাঁতরে মসজিদে আশ্রয় নেন। ঝড়ের পরে ঘরের দুইখান চাল খুঁজে পেয়েছেন। বাকি সব টিন ভেসে গেছে।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নে আজ বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, জোয়ারের পানিতে আবদুল জলিলের রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি প্লাবিত হচ্ছে। জোয়ারের বিশাল ঢেউ উঠে ক্ষতিগ্রস্ত বসতভিটায় আঘাত হানছে।
আবদুল জলিলের মতোই ইউনিয়নের আদর্শপাড়ার সিরাজুল ইসলামের ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। জোয়ার জলোচ্ছ্বাসে পুরো ঢালচর প্রায় ডুবে যায়। তিনি বাধ্য হয়ে চেয়ারম্যানের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সিরাজুল ইসলাম বলেন, তাঁর এখন ঘর তোলার সামর্থ্য নেই। তাই ভেসে যাওয়া ঘরের টিন–কাঠ কুড়িয়ে এনে জমা করে রেখেছেন। যদি কখনো সামর্থ্য হয়, তখন ঘর তুলবেন।
ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ঢালচরের ১৪৫টি ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতি হয়েছে সহস্রাধিক। ২০০টি পুকুর ও দেড় কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি হয়েছে। একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তাঁরা মাত্র ৫ টন চাল পেয়েছেন।
আমগো তেরান লাগবো না, আমগোরে পুনরবাসনের ব্যবস্থা করেন। আমরাযে ঘর উডামু হেই জাগা নাই। সব ভাঙি গেছে।
ইউনিয়নের আনন্দবাজারে চোখে পড়ে ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতের চিত্র। ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের আদর্শপাড়া ও ভদ্রপাড়া ঘুরে দেখা গেল, ঘূর্ণিঝড় সবকিছু এমনভাবে ধুয়ে নিয়ে গেছে যে মনে হয় এখানে বাড়িঘরই ছিল না। পুকুর ভেঙে নদীতে মিশে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, বিশাল বিশাল ঢেউ এসে ঘরের ভিটেমাটি ভাসিয়ে নেয়। তারপরে ঘরের বেড়া, হাড়িপাতিল ভাসিয়ে নেয়। মুরগির খোপ, রান্নাঘর সব ভাসিয়ে নিলে তিনি গলাসমান পানিতে সাঁতরে কোস্ট ফাউন্ডেশনের ভবনে আশ্রয় নিতে বের হন। পথে ভেসে যাচ্ছিলেন। তখন পেয়ারাগাছ ধরে অনেকক্ষণ ঝুলে ছিলেন। দুই দিন পর বাড়ি ফিরে দেখেন, ঘরের চাল ছাড়া কিছু নেই। তাঁর প্রায় এক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
রিনা বেগম ঘরে কাঠের মাচা করে বসত করছেন। তিনি বলেন, মাটি নাই, তাই ভিটে বানাতে পারছেন না। ভিটে বানালে তো আবার জোয়ার ভাসিয়ে নেবে। প্রতিবারই তো জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে।
ঘরবাড়ি প্লাবিত হওয়ায় খাওয়ার কষ্টেও ভুগতে হয়েছে বাসিন্দাদের। মো নুরে আলম বলেন, ‘যে দুই দিন কোস্ট ফাউন্ডেশনে আছিলাম, হে দুই দিন খিচুড়ি দিছে। হেনেত্তোন আওনের পরে চাইর দিন রান্দোনের অভাবে ধরতে গেলে না খায়া আছিলাম। পরে টিন কাডি তক্তাদি চুলা বানাইছি।’ মো. জামাল মাঝি বলেন, ‘আমগো তেরান লাগবো না, আমগোরে পুনরবাসনের ব্যবস্থা করেন। আমরাযে ঘর উডামু হেই জাগা নাই। সব ভাঙি গেছে।’
ক্ষতিগ্রস্ত জেলে রফিক কাটারি বলেন, ‘দেশের বলে বিস্তর উন্নয়ন অইছে, কিন্তুক ঢালচরের কোনো উন্নয়ন নাই। ঢালচরের মতো ইউনিয়নে কিয়ারে সাইক্লোন শেল্টার নাই। আমগোরে সরকার ঝড়েরসুম নিরাপদে যাইতে কয়, কিন্তুক কই যামু। ঢালচরে তো সাইক্লোন শেল্টার নাই।’
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত মো. বাবুল বলেন, ‘আমগো বাড়িত ৬০টা নাইরকোলগাছ আছিল। পাকা টিনের বাড়ি। পাকা ঘাটলা। ফল গাছের অভাব ছিল না। হেই বাড়ি ভাঙনে নি গেছে। এই চরে ৫০-৫৫ বছর ধরি বাস করি, কিন্তু ঝড়েরসুম মাথা গোঁজোনের ঠাঁই নাই।’
চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নওরীন হক বলেন, ঢালচরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ১ লাখ টাকা করে ২ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। সেগুলো এখনো বিতরণ হয়নি। শিশুখাদ্য, গোখাদ্য আসছে। তবে কোনো টিন পাওয়া যায় নাই।
ভোলা জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা খাদ্য সহায়তা দিয়েছি, আমাদের কাছে যে টিন ছিল, তা–ও প্রতি উপজেলায় ২০-২৫ বান্ডিল করে ভাগ করে পাঠিয়েছি। তারপরও মন্ত্রণালয় থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ৮ হাজার লোকের চাহিদা পাঠিয়েছি। আশা করা যায়, বরাদ্দ আসলে সকলে পাবে।’