ব্যারিস্টার সুমনের যে ‘ম্যাজিকে’ ধরাশায়ী বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী
হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী টানা দুবারের সংসদ সদস্য মাহবুব আলীকে পেছনে ফেলে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ সায়েদুল হক (ব্যারিস্টার সুমন)। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ পরিচিত মুখ। এই জয়-পরাজয় নিয়ে এলাকায় চলছে নানা আলোচনা।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর বাড়ি মাধবপুর উপজেলার বানেশ্বর গ্রামে। তিনি ২০১৪ সাল থেকে টানা দুবারের সংসদ সদস্য। এবারও দল তাঁকে নৌকার মনোনয়ন দেয়। তাঁর শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে ঈগল প্রতীক নিয়ে মাঠে ছিলেন যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ সায়েদুল হক। তিনি এলাকায় ‘ব্যারিস্টার সুমন’ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বাড়ি চুনারুঘাট উপজেলার বড়াইল গ্রামে। তিনি ছাত্রলীগের পরে যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এবার দল থেকে মনোনয়ন চেয়ে না পাওয়ায় তিনি ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ সায়েদুল হক পেয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯৯ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মাহবুব আলী পান ৬৯ হাজার ৫৪৩ ভোট। অর্থাৎ, দুজনের ভোটের ব্যবধান প্রায় এক লাখ।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, এমন ১০–১২ জন নেতা-কর্মীর সঙ্গে গতকাল সোমবার কথা হয় প্রথম আলোর এ প্রতিবেদকের। তাঁরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঘরানার দুজন প্রার্থী হওয়ার কারণে দলের নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েন। পাশাপাশি চা-বাগানের ভোটাররা এবার নৌকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ব্যারিস্টার সুমন চা-শ্রমিকদের ভোটের পাশাপাশি এলাকার তরুণসমাজ ও নতুন ভোটারদের সমর্থন পান।
অন্যদিকে বিমান প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর পাশে ছিলেন না স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এমনকি নৌকার ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত সেই চা-বাগানের শ্রমিকেরাও এবার তাঁকে সে অর্থে ভোট দেননি। মন্ত্রী হওয়ার পর এলাকায় তাঁর যাতায়াত ছিল কম। জনবিচ্ছিন্ন ও বিতর্কিত কিছু লোককে তিনি গুরুত্ব দিতেন। তাঁর হারের পেছনে এগুলোই মূল কারণ ছিল বলে জানান আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিমন্ত্রী ১০ বছর ধরে এ আসনের সংসদ সদস্য। ২০১৮ সালে মন্ত্রী হওয়ার পর এলাকায় আসতেন কম। যে কারণে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর দূরত্বের সৃষ্টি হয়। এটাই তাঁর পরাজয়ের মূল কারণ। পাশাপাশি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যারিস্টার সমুন এলাকার তরুণ ভোটারদের কাছে টানতে পেরেছেন। তরুণেরাই ছিলেন তাঁর মূল শক্তি।
এলাকার তরুণ ও চা-শ্রমিকদের ভোট আমি পেয়েছি। এ বিজয় সত্যিই আনন্দের। তবে এ অর্জনই শেষ নয়। আমার বড় দায়িত্ব মানুষের জন্য কাজ করা।
হবিগঞ্জ-৪ আসনকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বিবেচনা করা হয়। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকে আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই বেশির ভাগ সময় জয় পেয়েছেন। চা-বাগান অধ্যুষিত দুটি উপজেলায় চা-শ্রমিকদের ভোট আছে লাখখানেক। এই জয়–পরাজয়ের মূলের বড় অংশ চা-শ্রমিকদের ভোট। কিন্তু নৌকার প্রার্থী এবার সেই ভোট টানতে পারেননি।
ছন্দ্রিছড়া চা-বাগানের বাসিন্দা নতুন ভোটার কিরণ সাঁওতাল বলেন, ‘এলাকায় ফুটবল খেলাসহ নানা বিনোদনের আয়োজন করে সুমন ভাই তরুণদের কাছে টানেন। তিনি তরুণদের আইডল।’
উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, গত রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাধবপুর সুরমা চা-বাগানে চা-শ্রমিক ভোটার ৩ হাজার ৯০১ জন। ভোট প্রয়োগ হয় ২ হাজার ৪০৪টি। এতে নৌকা পায় ১ হাজার ৩৬০টি ভোট এবং স্বতন্ত্রী প্রার্থী ঈগল পায় ৯১১ ভোট। এখানে নৌকার বিপরীতে ঈগলের এ ভোট পাওয়াকে বিরাট সাফল্য হিসেবে গণ্য করেন স্থানীয় রাজনীতিকেরা।
২৩টি চা-বাগান নিয়ে গঠিত লস্করপুর ভ্যালির সভাপতি ও বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক রবীন্দ্র গৌর বলেন, ‘এবার নৌকার পাশাপাশি ঈগলেও ভোট দিয়েছেন আদিবাসী চা–শ্রমিকেরা। আদর্শের চিন্তা থেকে এ ভোট দেওয়া হয়নি, দেওয়া হয়েছে ক্ষোভ থেকে। এ ক্ষোভ ছিল বিমান প্রতিমন্ত্রীকে চা-শ্রমিকদের পাশে না পাওয়ার। তিনি এলাকায় আসতেন কম। যে কারণে তাঁর সঙ্গে সাধারণ চা-শ্রমিকদের দূরত্ব বাড়ে।’
চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ওপরে–ওপরে প্রতিমন্ত্রীর পক্ষে আছেন বা কাজ করছেন, এমনটা দেখালেও ভেতরে-ভেতরে তাঁরা কেউই নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি।
প্রতিমন্ত্রীকে দলের নেতা-কর্মীরা কোনো সময়ই কাছে পাননি। দলীয় লোকজন বা এলাকার কেউ তাঁর কাছে গেলে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী মোছাব্বির হোসেন ওরফে বেলালকে দেখিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। এ ছাড়াও এলাকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, এমন বিতর্কিত লোকজনকে গুরুত্ব দিতেন তিনি।মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন
মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও মাধবপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র শাহ মোহাম্মদ মুসলিম, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বহরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন, জগদিশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মাসুদ খান, একই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বাবুল হোসেন, শাহজাহানপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি লিয়াকত আলী, মাধবপুর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আতাউস সামাদ, চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রজব আলীসহ অসংখ্য নেতা-কর্মী সায়েদুল হকের পক্ষে কাজ করেন।
এ বিষয়ে মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন বলেন, প্রতিমন্ত্রীকে দলের নেতা-কর্মীরা কোনো সময়ই কাছে পাননি। দলীয় লোকজন বা এলাকার কেউ তাঁর কাছে গেলে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী মোছাব্বির হোসেন ওরফে বেলালকে দেখিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। এ ছাড়াও এলাকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, এমন বিতর্কিত লোকজনকে গুরুত্ব দিতেন তিনি। তাই দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মী ক্ষোভ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী সায়েদুল হকের জন্য কাজ করেন।
সায়েদুল হক সুমন বিজয়ের পর তাঁর প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকার তরুণ ও চা-শ্রমিকদের ভোট আমি পেয়েছি। এ বিজয় সত্যিই আনন্দের। তবে এ অর্জনই শেষ নয়। আমার বড় দায়িত্ব মানুষের জন্য কাজ করা। আমি এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে দুটি উপজেলার আট লাখ মানুষের দায়িত্ব নিয়েছি। এখন তাঁদের পরামর্শে এলাকার উন্নয়নে কাজ করাই মূল উদ্দেশ্য। কাজেই মানুষগুলোর কথা বিবেচনায় নিয়েই আমাকে সামনে চলতে হবে।’
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর সঙ্গে কথা বলতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ সায়েদুল হক পেয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯৯ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মাহবুব আলী পান ৬৯ হাজার ৫৪৩ ভোট। অর্থাৎ, দুজনের ভোটের ব্যবধান প্রায় এক লাখ। সায়েদুল হক ও মাহবুব আলী ছাড়াও এ আসনে অপর ছয় প্রার্থী ছিলেন আবু ছালেহ (ইসলামী ঐক্যজোট), আহাদ উদ্দিন চৌধুরী (জাতীয় পার্টি), মোহাম্মদ আবদুল মমিন (ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ), মো. মোখলেছুর রহমান (বিএনএম), মো. রাশেদুল ইসলাম (বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট) এবং সৈয়দ মো. আল আমিন (বাংলাদেশ কংগ্রেস)।