‘অলির পিঠা’ নামেই সবাই তাঁকে চেনেন
হাটের মোড়ে পথের ধারে রাখা চুলায় যখনই আগুন দিয়ে অলিমা হাঁড়ি উঠিয়ে দেন, তখন থেকেই ভিড় লেগে যায় ক্রেতাদের। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা তৈরি করেন অলিমা, তা পরম তৃপ্তিতে খান হাটুরেরা।
অলিমা বলেন, ‘মোর কষ্টের দিন আছলো। মাইনষের বাড়িত খুঁজি খাছুন। এ্যালা পিঠা বেঁচে ভালো দিন যাওছে। মানুষ লাইন দিয়া মোর পিঠা তৃপ্তি করি খায়, তাক দেখি মোর প্রাণটা ভরি যায়। কাস্টমারের (ক্রেতা) এতো ভিড় পিঠা বানার কুল পাওছু না। মাঠোত কাম করা মানুষ মোর বেশির ভাগ কাস্টমার। প্রতিদিন মুই ৫০০ থাকি ৬০০ টাকা কামাই করুছুন। অলির পিঠা কইলে বাজারোত মোক এক নামে চেনে।’
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের ফকিরপাড়া গ্রামে অলিমার বাড়ি। একসময় এবাড়ি-ওবাড়ি খুঁজে জীবিকা নির্বাহ করা অলিমার এখন বেঁচে থাকার পথ এই পিঠা বিক্রি। ইকরচালী বাজারে বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০ টাকা পর্যন্ত তিনি পিঠা বিক্রি করেন। শীতের সময় ভাপা পিঠার চাহিদা বেশি ও গ্রীষ্মকালে চিতই পিঠার চাহিদা সব থেকে বেশি থাকে।
অলিমা বেগম জানান, তাঁর দুই সন্তান। দুজনেই মেয়ে। স্বামী মফেল উদ্দিন ২০ বছর আগে মারা গেলে সংসার নিয়ে অকূলপাথারে পড়েন তিনি। দুমুঠো ভাতের কষ্ট দূর করতে ছোট বয়সেই বিয়ে দেন দুই মেয়েকে। বড় মেয়ে স্বামীর সংসারে সন্তানদের নিয়ে ঘর করলেও, ছোট মেয়েকে ফিরে আসতে হয়েছে বৃদ্ধ অলিমার ঘরে। এবাড়ি–ওবাড়ি ঘুরে যেখানে একার খাবারের কষ্ট, সেখানে মেয়ে ও নাতনি এসে পড়ে তাঁর সংসারে। অকূলপাথারে পড়েন অলিমা। তাঁর কষ্ট দেখে ২০১৫ সালে প্রতিবেশী সফিকুল ইসলাম ইকরচালী বাজারে পিঠা তৈরির পরামর্শ দেন। সেই থেকে পথচলা শুরু। বাড়ির অদূরেই ইকরচালী হাটে পিঠা বিক্রি শুরু করেন অলিমা। পরিচয় বদলে যায় তাঁর। এখন তাঁকে ‘অলির পিঠা’ নামে সবাই চেনেন। পাঁচ ঘণ্টা পিঠা বিক্রি করে এখন তাঁর ৬০০ টাকা আয়। মেয়ে নাতনিকে নিয়ে সুখের সংসার তাঁর। আয়ের টাকায় দুটি গাভি ও তিনটি ছাগল কিনেছেন। খাঁচাভর্তি হাঁস-মুরগি রয়েছে তাঁর। তাঁর দেখে লক্ষ্মীপুর গ্রামের জহরা বেগম, জগদীশপুর গ্রামের মমেনা বেগমও বাজারে পিঠা তৈরি করে বিক্রি করছেন।
আজ শুক্রবার ইকরচালী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সড়কের ধারে বসে পিঠা তৈরি করছেন অলিমা। তাঁকে ঘিরে আছেন ক্রেতারা। চুলা থেকে পিঠা নামানোর সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রেতাদের হাতে চলে যাচ্ছে। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠার সঙ্গে ধনেপাতার ভর্তা, শুটকিভর্তা, মাছভর্তা, ঝালভর্তা দেওয়া হয়। প্রতিটি ভাপা পিঠা ১০ টাকা আর চিতই পিঠা ৫ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
পিঠা খেতে আসা মেনানগর গ্রামের হারেস মিয়া বলেন, ‘সারা দিন মাঠে কামকাজ করি, বাজারে আসলে খিদা লাগে। হোটেলে নাশতা খেতে গেলে ৩০-৪০ টাকা কম হয় না। ১০ টাকায় অলির পিঠা খাই, পেট ভরে যায়।’
আরেক হাটুরে প্রামাণিকপাড়া গ্রামের বাবুল মিয়া বলেন, অলির পিঠা বাজারে নামকরা। বিশেষ করে ভাপা পিঠা। পিঠার মাঝখানে গুড় দেয়। আর খাওয়ার সময় ঝাল ভর্তা। তাঁর পিঠার স্বাদই আলাদা। অলির পিঠা খেতে এলে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়।
অলির পিঠার দোকানের পাশের গালামাল ব্যবসায়ী মহুবার হোসেন বলেন, অলি প্রথম পিঠার ব্যবসার বাজারে শুরু করেন। এরপর তাঁর দেখে আশপাশে আরও দুই–চার জন পিঠা বিক্রি করছেন। শীতে তাঁর পিঠার দোকানে সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে।