‘মা মারা গেছে, আব্বু জেলে, আমরা চার ভাই-বোন কার কাছে থাকব’
সাজ্জাদ মিয়ার বয়স ১৩। এ বয়সে দুরন্তপনা ও সহপাঠীদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠার কথা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সাজ্জাদের। এই বয়সেই সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে চেপে বসেছে।
ছয় বছর বয়সী বোন আফসানা আক্তার, এক মাস বয়সী যমজ বোন আনিশা ও তানিশাকে নিয়ে সাজ্জাদ এখন দিশাহারা। শিশুটি বলছে, ‘মা মারা গেছে, আব্বুকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আমরা কার কাছে থাকব? কে আমাদের দেখাশোনা করবে?’
সাজ্জাদ মিয়া গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার আমতলী ইউনিয়নের চিত্রাপাড়া গ্রামের জামাল মিয়ার ছেলে। গত ১২ অক্টোবর সাজ্জাদের মা সাথী বেগম যমজ সন্তান জন্মের এক সপ্তাহ পর মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা জামাল মিয়া তাঁর চার সন্তানকে লালন-পালন ও বৃদ্ধা মাকে দেখভাল করতেন।
গোপালগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা শওকত আলী দিদার হত্যা মামলায় সাজ্জাদের বাবা জামাল মিয়াকে ৯ নভেম্বর গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায় কোটালীপাড়া থানা-পুলিশ। তিনি পেশায় একজন দিনমজুর ছিলেন। চার ভাই-বোনের আশ্রয় এখন অশীতিপর অসুস্থ দাদি গোলজান বেগমের কাছে। দাদির নিজের চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। মা–হারা চার সন্তানের বাবাও জেলহাজতে। ছোট তিন বোনদের নিয়ে দিশাহারা শিশু সাজ্জাদ মিয়া।
সাজ্জাদ মিয়া স্থানীয় এম এম খান উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে এবং বোন আফসানা আক্তার ৪৭ নম্বর চিত্রাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থী। অভিভাবক না থাকায় তাদের পড়ালেখা এখন বন্ধ হতে চলেছে।
গতকাল বুধবার সকাল ১০টায় কোটালীপাড়ার চিত্রাপাড়া গ্রামের জামাল মিয়ার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, আধা পাকা ঘরের সামনের উঠানে এক মাস বয়সী দুই বোনকে নিয়ে চেয়ারে বসে আছে সাজ্জাদ মিয়া ও বোন আফসানা আক্তার। বাড়িতে কয়েকজন প্রতিবেশী তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন। দুই ভাই-বোনের মুখে হতাশা ও বিষণ্নতার ছাপ। তারা মা-বাবার পথ চেয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। কিছু সময় পর দাদি গোলজান বেগম ও নানি শাহিনুর বেগম তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। দাদি বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন।
সাজ্জাদ মিয়া বলে, ‘মা মারা গেছে, আব্বুকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আমরা কার কাছে থাকব? কে আমাদের দেখাশোনা করবে? কয়েক দিন পরেই আমার বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। আমার স্কুলের বেতন ও পরীক্ষার ফি কে দেবে? আমার এক মাস বয়সী দুই বোনের দুধের টাকা কে দেবে? বাড়ির আশপাশের লোকজন আমাদের খাবার দিচ্ছে, এভাবে কত দিন চলবে? আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই।’
নানি শাহিনুর বেগম বলেন, ‘এক মাস আগে আমার মেয়ে সাথী একসঙ্গে দুই কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। ছয় দিন পর সে মারা যায়। যমজ দুটি মেয়ে মায়ের আদর ও ভালোবাসা পায়নি। আমার মেয়ে মারা যাওয়ার পর জামাতা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। চার ছেলে-মেয়ে ও তার মাকে দেখাশোনা করত। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। কী অপরাধ করেছিল আমার জামাতা? সে দিনমজুরের কাজ করত। এ দেশে কোটি কোটি টাকা যারা লুটে খেয়েছে, তারা তো দিব্যি ভালো আছে। অবুঝ চারটি বাচ্চা নিয়ে কী করব আমরা? আল্লাহ এই মাসুম বাচ্চাদের কপালে এত কষ্ট দিয়ে পাঠাল?’
জামাল মিয়ার ভাই মনির মিয়া বলেন, ‘আমার ভাই বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নেই। একসময় সে আমতলী ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ছিল। পুলিশ কী কারণে আমার ভাইকে ধরে নিয়ে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠিয়েছে, তা আমাদের জানা নেই। এখন জামালের চার শিশুসন্তানকে দেখাশোনা করার কেউ নেই। দ্রুত সময়ের মধ্যে আমি আমার ভাইয়ের মুক্তি চাই।’
চিত্রাপাড়া গ্রামের তৈয়ব মিয়া বলেন, ‘জামাল কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেই। তারপরেও তাকে কেন একটি রাজনৈতিক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হলো? জামালের অবুঝ চার শিশুসন্তানের দায়িত্ব এখন কে নেবে? জামালকে গ্রেপ্তার করা সম্পূর্ণ অন্যায় ও অমানবিক। তাই এই চার শিশুসন্তান ও অসুস্থ মায়ের দিকে তাকিয়ে আমরা এলাকাবাসী জামালের মুক্তির দাবি জানাই।’
কোটালীপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা শওকত আলী দিদার হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে জামাল মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি ঢাকার তেজগাঁও থানা শ্রমিক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন বলে আমরা জেনেছি।’