মোগল আমলের নিদাড়িয়া মসজিদে এখনো নামাজ পড়েন মুসল্লিরা, দেখতে আসেন দূরদূরান্তের মানুষ
লালমনিরহাট জেলার প্রাচীন স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল নির্দশন হিসেবে কয়েক শ বছর ধরে গৌরবের সঙ্গে টিকে আছে নিদাড়িয়া মসজিদ। মোঘল আমলে নির্মিত মসজিদটিতে এখনো নিয়মিত নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। আশপাশের এলাকার পাশাপাশি দূরদূরান্ত থেকেও সাধারণ মানুষ দেখতে আসেন মসজিদটি।
রংপুর-কুড়িগ্রাম সড়কের প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণে লালমনিরহাট সদরের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের কিসামত নগরবন্দ মৌজায় নিদাড়িয়া মসজিদের অবস্থান। মসজিদের নির্মাতা সম্পর্কে খোদাই করা তথ্য বোধগম্য না হলেও শিলালিপিতে নির্মাণকাল ১১৭৬ হিজরি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত তিন গম্বুজ ও তিন দরজাবিশিষ্ট মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট এবং প্রস্থ ১৬ ফুট ৮ ইঞ্চি। মসজিদের পশ্চিম দেয়াল থেকে বর্ধিত কোনো মিহরাব নেই। দেয়ালের ভেতরের দিকের সামান্য ফাঁকা অংশ মিহরাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দরজার কাছের দেয়ালের পুরুত্ব ৩ ফুট।
মসজিদটির দেয়াল বরাবর ওপরে চারদিকে ছোট–বড় মিনার রয়েছে ১২টি। সামনে প্রাচীরের প্রবেশপথের দক্ষিণ দিকে ১৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট প্রস্থের একটি হুজরাখানা রয়েছে।
১৯৯৭ সালে নিদাড়িয়া মসজিদটি বাংলাদেশের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক পুরাকীর্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। মসজিদ–সংলগ্ন স্থানে বাংলা ও ইংরেজিতে জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের স্থাপন করা সাইনবোর্ডে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি এই পুরাকীর্তির কোনো রকম ধ্বংস বা অনিষ্ট সাধন করলে বা এর কোনো বিকৃতি বা অঙ্গচ্ছেদ ঘটালে বা এর কোনো অংশের ওপর কিছু লিখলে বা খোদাই করলে বা কোনো চিহ্ন বা দাগ কাটলে ১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনে সর্বাধিক এক বছর পর্যন্ত জেল, জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও লালমনিরহাট জেলা জাদুঘর থেকে ২০০৭ সালের ১৭ অক্টোবর ‘লালমনিরহাট জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থের ১৩০ থেকে ১৩১ পৃষ্ঠায় নিদাড়িয়া মসজিদ–সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। এতে জনশ্রুতির বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়, মোগল সুবেদার মাসুদ খাঁ তাঁর পুত্র মনসুর খাঁর তত্ত্বাবধানে মসজিদটি নির্মাণ করেন। সুবেদার মাসুদ খাঁর কোনো দাড়ি ছিল না। তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যে তাঁর যদি একটি দাড়িও গজায়, তবে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করবেন। আল্লাহ তাঁর আশা পূরণ করেছিলেন, একটিমাত্র দাড়ি দান করেন। দাড়ি গজানোর পর তিনি (মোগল সুবেদার মাসুদ খাঁ) তাঁর পুত্র মনসুর খাঁর তত্ত্বাবধানে মসজিদটি নির্মাণের মাধ্যমে তাঁর মানত পূরণ করেন।
বইটিতে আরও উল্লেখ করা হয়, মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষে মনসুর খাঁর রক্ষণাবেক্ষণসহ যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করার জন্য মসজিদের জন্য ১০ একর ৫৬ শতক জমি দান করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বহু বছর ধরে এলাকাটি জঙ্গলাচ্ছন্ন থাকার পর ১৯৫০–এর দশকে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু মুসলিম পরিবার এই এলাকায় বসতি স্থাপনকালে মসজিদটি সামনে চলে আসে। বর্তমানে মসজিদটির নামে জমির পরিমাণ ২ একর ৮০ শতক। মসজিদটির পশ্চিম দিকে চকচকার বিল নামে একটি বৃহৎ জলাশয় রয়েছে। সুদূর অতীতে এখানে একটি নদীবন্দর ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
নিদাড়িয়া মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. জাহানুর রহমান বলেন, মসজিদটি অনেক পুরোনো, মোগল আমলের। মসজিদটি দর্শনীয় স্থান হওয়ায় স্থানীয়সহ দূরদূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ও সাধারণ মানুষ দেখতে আসেন।
পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের বাসিন্দা ও কলেজশিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, নিদাড়িয়া মসজিদ লালমনিরহাট জেলাকে সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিসহ দর্শনার্থী মানুষের কাছে অন্য রকম পরিচিতি এনে দিয়েছে। এটা আবহমানকালের একটা ঐতিহ্য হিসেবে টিকে আছে। এ মসজিদকে ঘিরে কীভাবে এখানে পর্যটনশিল্প–ঘনিষ্ঠ পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, সেটা নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লালমনিরহাট জেলা জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং ‘লালমনিরহাট জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক মো. আশরাফুজ্জামান মন্ডল বলেন, ‘পৃথিবীর যেখানে এ ধরনের প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প রয়েছে, সেগুলো পরিদর্শন করতে অনেক মানুষ যান। এগুলো তাঁদের দেশের পর্যটনশিল্প বিকাশের সহায়ক। আমরা লালমনিরহাটের অন্যান্য প্রাচীন স্থাপত্য সংরক্ষণের মাধ্যমে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপন করতে পারি। সেদিকটা ভেবে দেখতে হবে।’
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, মসজিদটি মোগল আমলের, বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের নীতিমালা অনুয়ায়ী মসজিদটিকে সংরক্ষণের দাবি এলাকার লোকজনের। সেই লক্ষ্যে প্রশাসনের সহযোগিতা রয়েছে। ভবিষ্যতেও থাকবে।