‘ভোটে উত্তাপ না থাকলি কি হয়’

নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারাছবি: প্রথম আলো

আবছা কুয়াশায় মোড়ানো হেমন্তের সকাল। দিনের প্রথম আলো ছড়াতে শুরু করেছে পুব আকাশে। খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে সকালের আলো যত বাড়ে, লোকজনের উপস্থিতিও বাড়তে থাকে। অধিকাংশ মানুষের হাতে জাল ও নৌকার বইঠা। ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সুন্দরবনের গহিনে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কথা শুরু করতেই যাঁর যাঁর মতো মন্তব্য করতে থাকেন। কেউ কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে শোনেন।

সুন্দরবনসংলগ্ন মঠবাড়ি গ্রামের বনজীবী মৌয়াল আবু মুসা ভোটের প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, ‘আমরা হলাম পেটনীতির মানুষ। গরিব মাইনষের চিন্তা তো আগে এইটাই, রুজিরোজগার করা। জীবনে বহুবার ভোট দিয়ে বুঝেছি, গরিব মাইনষের জন্য ভোট না। ভোট নেতা-গোতাগের জন্যি। আমরা ভোট দিলিও কী আর না দিলিও–বা কী।’

জেলে আনারুল ইসলাম সুন্দরবনের মধ্যের নদী থেকে মাছ ধরে লোকালয়ে ফিরেছেন। ভোটের কথা তুলতেই তিনি বললেন, ‘সুযোগ পাইলে ভোট দিবানে। তয় ভোট দেওনের সুযোগ পাব বলে মনে হয় না।’

কয়রার শাকবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধ ধরে সামনে এগিয়ে গেলে সুন্দরবন–লাগোয়া গ্রাম কাশিয়াবাদ, ৪ নম্বর কয়রা, গুড়িয়াবাড়ী, পাথরখালী ও কাটকাটা। এসব গ্রামের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বাপ–দাদার আমল থেকে বনের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। পাথরখালী গ্রামের বেড়িবাঁধের ওপর বসে জাল মেরামত করছিলেন বৃদ্ধ জেলে রুহুল আমিন। কাজের ফাঁকে তিনি বললেন, ‘ইলেকশন আইছে জানি। তবে আগের মতো উত্তাপ নেই। আলোচনাও নেই। নীরবে ক্যামনে যেন ভোট হইয়ে যায়। ভোটে উত্তাপ না থাকলি কি হয়?’

কাটকাটা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় একটি চায়ের দোকানের সামনে কিছু মানুষের জটলা। কেউ চা পান করছেন। কেউ চায়ের জন্য অপেক্ষায়। ফাঁকে ফাঁকে চলছে নির্বাচন নিয়ে আলাপ। কাপের মধ্যে চায়ে বনরুটি ভিজিয়ে খাচ্ছিলেন একজন। নাম ওমর ফারুক। পেশায় ট্রলারচালক। ভোটের কথা তুললে ফারুক বলেন, ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলের লোক ভোটে না থাকলে খেলা জমে না?’

আমরা হলাম গরিব মানুষ। ভোট নিয়া চিন্তা করার সময় নাই আমাগে। সুষ্ঠু নির্বাচন অইলে যে এমপি হোক, আমাগে কোনো সমস্যা নাই। গরিব মানুষ। সরকারি কিছু পাইলে পাইলাম। না পাইলে নাই।
ফরিদা বেগম, নারী শ্রমিক
বেড়িবাঁধে কাজের ফাঁকে নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন নারী শ্রমিকেরা। শুক্রবার খুলনার কয়রা উপজেলার হরিহরপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

চায়ের জন্য অপেক্ষারত সুব্রত কুমার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ থেকে যারে মনোনয়ন দিছে, তারে তো অধিকাংশ মানুষ চেনেই না। শুনেছি, আগে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন।’ তাঁর কথা শেষ না হতেই পাশে দাঁড়ানো ভ্যানচালক সিরাজুল ইসলাম বলে উঠলেন, ‘এইবার আওয়ামী লীগের অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবে। তবে যা–ই হোক নির্বাচনের দিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে মারামারি না হলেই হলো। আমরা চাই সুষ্ঠু নির্বাচন।’

সুন্দরবনঘেঁষা হরিহরপুর এলাকায় কপোতাক্ষ নদের বাঁধের ওপরের মাটি সমান করার কাজ করছিলেন একদল নারী শ্রমিক। কাছে যেতেই কিছুটা কৌতূহলী চোখে তাকালেন সবাই। ভোটের চিন্তাভাবনা কী তা জিজ্ঞাসা করতেই নারী শ্রমিক ফরিদা বেগম বললেন, ‘আমরা হলাম গরিব মানুষ। ভোট নিয়া চিন্তা করার সময় নাই আমাগে। সুষ্ঠু নির্বাচন অইলে যে এমপি হোক, আমাগে কোনো সমস্যা নাই। গরিব মানুষ। সরকারি কিছু পাইলে পাইলাম। না পাইলে নাই।’

পাশ থেকে সুরভী রানী নামের আরেকজন বলেন, ‘ভোটার হইছি, কিন্তু আর ভোট দেব না।’ তাঁর যুক্তি, ভোট দিয়ে তাঁদের ভাগ্য বদল হয় না। ভোট শেষ হলেই জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের মতো জনগণকে বেমালুম ভুলে যান।

কয়েক দিনে কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ২৫ থেকে ৩০ জন মানুষের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলাপ হয়। অনেকেই নির্বাচনের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। কেউ কেউ বিএনপি না থাকায় একতরফা ভোট নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। আবার অনেকের মধ্যে ভালো ভোট হবে—এ আশাবাদও আছে।

খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন মোট ১২ জন।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, এসব ভাবনা উপকূলের শ্রমজীবী কিছু মানুষের হলেও সামগ্রিক বাস্তবতাটাও জনগণের কাছে খুব পরিষ্কার। কিন্তু তারপরও মানুষ দূরদূরান্ত থেকে ছুটে যাবেন ভোট দিতে। জয়ী করবেন পছন্দের প্রার্থীকে। তাঁদের প্রত্যাশা, ভোটের পর রাজনীতিকেরা যেন কাজ করেন মানুষের কল্যাণে।