পথেই বেড়ে উঠছে ‘ফুল’
ঘড়ির কাঁটায় রাত ১১টা। ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কেউ শুয়ে আছেন, কেউবা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একটি কম্বলের অর্ধেক বিছিয়ে শুয়ে আছে শিশু মোমেন মিয়া (১৪)। বাড়ি নেত্রকোনায়। সৎমায়ের অত্যাচারে বাড়ি ছেড়েছে। কয়েক দিন স্টেশনে পানির বোতল বিক্রি করে এখন একটি হোটেলে কাজ করে। তা দিয়েই কোনোমতে পেটেভাতে চলছে তার। কখনো স্কুল দেখেনি সে।
মোমেনের মতো ময়মনসিংহে কত পথশিশু আছে, সে তথ্য কোনো সরকারি দপ্তরে নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পথশিশু জরিপ ২০২২ অনুযায়ী ময়মনসিংহে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী পথশিশুর হার ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। ময়মনসিংহ রেলস্টেশন ছাড়াও নগরের বিভিন্ন এলাকায় তারা অযত্ন-অবহেলায় বেড়ে উঠছে। পরিবার থাকলেও কেউ অভিমানে বাড়ি ছেড়েছে, কারও আবার মা-বাবা ফেলে গেছেন। কেউ আবার মা–বাবার পরিচয়ও জানে না। এরই মধ্যে আজ বুধবার পথশিশু দিবস পালিত হচ্ছে।
কেমন আছে শিশুরা
১৩ বছর বয়সী নয়ন তার মা ও বাবা কে, জানে না। জিজ্ঞাসা করতেই ছলছল চোখে বলে, ‘ছোডু বালা থাইক্যা ইস্টশনে মাইনষ্যের লাত্থিগুতা খাইয়া বড় অইতাইছি। আমার বাপ-মা কেলা, কেউ কইতে পারে না। হোটেলে কলস ভইর্যা পানি দেই। বিনিময়ে তিন বেলা ভাত খাইতে দেয়, ৫০-৬০ টেহা খরচের লাইগ্যাও দেয়।’
শাওন মিয়া (১০) ময়মনসিংহ সদরের পরানগঞ্জ এলাকায় নানির কাছে থাকত। তার মা মুকুলি। বাবা কে, বলতে পারে না সে। ঢাকায় একটি হোটেলে কাজ করলেও এক মাস ধরে ময়মনসিংহ স্টেশনে এসেছে। এখানে পপকর্ন বিক্রি করে সে। শাওন বলে, ‘টেহা কামাই কইর্যা নানির কাছে যামু।’
রাতে ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘুমান ব্যবসায়ী শামছুল হক (৪০)। জেলার ত্রিশাল উপজেলার আউলিয়ানগর এলাকার বাসিন্দা শামসুল সপ্তাহে এক দিন বাড়িতে যান। রেলস্টেশন এলাকায় হোটেলে পানি সরবরাহ, ট্রেনে পানির বোতল ও পপকর্ন বিক্রি করেন। পথশিশুরা তাঁর বিক্রির কাজ করে।
শামছুল হক বলেন, ‘পোলাপানগুলারে বাপ-মায়ে দেহে না। আমি তো তিন বেলা খাওয়াইতাছি, নাইলে চুরি করত। যে পোলাপানগুলো হুদাই ঘুরত, তারারে ব্যবসা শিখাইতাছি। তারারে আগলাইয়্যা রাখছি।’
নগরের গাঙ্গিনারপাড় এলাকার প্রেসক্লাব মার্কেটে গিয়ে এমন আরও কয়েকটি শিশুকে দেখা গেল। কেউ কেউ নগরের বিভিন্ন বস্তিতে থাকে। কেউ আবার ভিক্ষা করে। শিশু আলিফ আসলাম বলে, ‘মানুষের কাছে গিয়া বলি, খুব খিদা লাগছে, ১০টা টেহা দেন ভাত খামু। হয় ভাত খাওয়ান, নাইলে টেহা দেন। প্রতিদিন এক-দেড় শ টাকা পাই। পরে টাকা নিয়ে মায়ের হাতে দেই।’
পথশিশুদের জন্য প্রকল্প
পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে ‘আলোকিত শিশু প্রকল্প’ নামে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা কারিতাস। ২০১৮ সাল থেকে নগরের ৮, ৯, ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে তাদের কার্যক্রম। শিশুদের পারিবারিক সুবিধা পাইয়ে দিতে ও সমাজের মূলস্রোতে ফেরাতে চার ধরনের শিশুদের নিয়ে কাজ করছে সংস্থাটি।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান, ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাস্তায় একা থাকে, এমন ৯০ শিশু; মা-বাবাসহ রাস্তায় থাকে, এমন ১৫১; পরিবারের সঙ্গে বস্তিতে বা ঝুপড়িতে থাকলেও অধিকাংশ সময় রাস্তায় থাকে, এমন ২৪৩ এবং অন্যের আশ্রয়ে থাকে, এমন ৩২ শিশুকে নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন। এর মধ্যে ১২ জনের পরিচয় শনাক্ত করে পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সংস্থাটি। শিশুদের রাত্রিযাপনের ব্যবস্থার পাশাপাশি সংস্থাটি তিন বেলা খাবার, মৌলিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিনোদন, খেলাধুলার ব্যবস্থা করে।
প্রকল্পের মাঠ কর্মকর্তা বিপাশা মানখিন প্রথম আলোকে বলেন, শিশুরা পরিবারে থাকলে যেমন সুবিধা পেত, তাঁরা তেমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। পথশিশু বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি দারিদ্র্য, মা–বাবার অসচেতনতা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, মা–বাবার ছাড়াছাড়িসহ নানা কারণের কথা উল্লেখ করেন। বাড়িতে ফিরতে হবে ভেবে শিশুরা সঠিক পরিচয় দিতে চায় না। ধীরে ধীরে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাদের পরিবারে ফেরত পাঠানো হয়।
নগরের পাটগুদাম ব্রিজ মোড় এলাকায় আলোকিত শিশু প্রকল্পের একটি কেন্দ্র আছে। গতকাল মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শিশুদের একটি কক্ষে পাঠদান করা হচ্ছে। কেন্দ্রে পাওয়া গেল ১১ বছর বয়সী উজ্জ্বল মিয়াকে। মা নূর জাহান মানসিক ভারসাম্যহীন। থাকে জামালপুর রেলস্টেশনে। ১৫ দিন হলো সে এখানে এসেছে। উজ্জ্বল জানায়, ময়মনসিংহ স্টেশনে আসার পর আরেক শিশু তাকে এখানে নিয়ে আসে। এখানে বিনা মূল্যে তিন বেলা থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা আছে।
নগরের এস কে হাসপাতালের পেছনে শান্তি মিত্র সমাজকল্যাণ সংস্থা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষা ও অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় ‘আমরা সবাই রাজা’ নামে একটি ক্লাব চালায়। সংস্থাটির মাধ্যমে শিশুদের নৈতিক শিক্ষা, গান, নাচ, কবিতা আবৃত্তি ও ছবি আঁকা শেখানো হয়। গতকাল ক্লাবে গিয়ে দেখা গেল, দুটি কক্ষে দুজন শিক্ষক শিশুদের ছবি আঁকতে দিয়েছেন। হরিজনপল্লিসহ আশপাশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা এসেছে। কারও মা–বাবা আছে, কারও আবার নেই।
বিকেলে ৫০ ও সকালে ২৮ শিশুকে পাঠদান করা হয় জানিয়ে প্রকল্প কর্মকর্তা আবু হানিফ বলেন, ‘আমরা আগে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতাম। এখন শুধু সুবিধাবঞ্চিতরা আছে। পথশিশুর সঠিক সংখ্যা কারও কাছে নেই।’
পথশিশুদের তথ্য সংরক্ষণে নেই
ময়মনসিংহে কত পথশিশু আছে, কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারি দপ্তরগুলোতে। পথশিশু জরিপ ২০২২ অনুযায়ী ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী পথশিশুর হার ৬ দশমিক ৯ শতাংশ জানিয়ে ময়মনসিংহ জেলা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের উপপরিচালক সৌরভ পাল বলেন, জেলাগুলোর মধ্যে দেশে পথশিশুর হার ময়মনসিংহে সর্বোচ্চ। তবে জেলায় কতসংখ্যক পথশিশু রয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা তাঁদের কাছে সংরক্ষিত নেই।
জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা মো. মেহেদী হাসান বলেন, ‘পথশিশুদের তথ্য আমাদের সংরক্ষণে নেই। কাজটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের, আমরা করি না।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরের ময়মনসিংহের উপপরিচালক রাজু আহমেদ বলেন, ‘কী পরিমাণ পথশিশু আছে, আমাদের কাছে পরিসংখ্যান নেই। কখনো আমরা জরিপ করিনি। তবে শিশুবিষয়ক কর্মকর্তার কাছে থাকতে পারে।’ তিনি বলেন, স্বপ্রণোদিত হয়ে শিশুদের ধরে আনা হয় না। কোনো শিশু আইনের সংস্পর্শে এলে তাঁরা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন।
আনন্দ মোহন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রধান জরিনা মজুমদার বলেন, পথশিশুদের মূলধারায় ফেরাতে হবে। এ জন্য প্রথমে পথশিশুরা সংখ্যায় কত, কী কারণে বাড়ছে, সেসব বিবেচনায় নিতে হবে। কাজটি অবশ্যই সরকারি পর্যায় থেকেই করতে হবে।