‘আমার ছেলের রক্তের বদলে দেশে শান্তি ফিরে আসুক’

কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিতে নিহত ছেলে রেদোয়ান হাসানের ছবি দেখাচ্ছেন বাবা আসাদুজ্জামান। আজ শুক্রবার দুপুরে ময়মনসিংহ নগরের আকুয়া চৌরঙ্গী মোড় এলাকার বাড়িতেছবি: প্রথম আলো

অনার্সপড়ুয়া রেদোয়ান হাসান ওরফে সাগর (২৪) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন আজ আট দিন হলো। এখনো শোকে কাতর তাঁর পুরো পরিবার। একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি রেদওয়ানের মা–বাবা। তাঁদের চাওয়া, সন্তানের রক্তের বিনিময়ে হলেও এই দেশে শান্তি নেমে আসুক।

গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) ময়মনসিংহ নগরের মিন্টি কলেজ এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন রেদোয়ান। সেদিন সন্ধ্যা সাতটার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এতে নিহত হন রেদোয়ান হোসেন। সংঘর্ষে আহত হন অন্তত ৩৫ জন। সেদিন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক জাকিউল ইসলাম প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, রেদোয়ানের শরীরে বুলেটের আঘাত ছিল। তাঁকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল।

রেদোয়ান ময়মনসিংহ নগরের আকুয়া চৌরঙ্গী মোড় এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামানের ছেলে। রেদোয়ান ও আফিয়া তাবাসসুম—দুই ভাই–বোনের মধ্যে রেদোয়ান বড় ছিলেন। তিনি ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষে চতুর্থ বর্ষে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি ময়মনসিংহ নগরে এমএম কম্পিউটার নামে একটি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। হিসাববিজ্ঞানে পড়লেও তথ্যপ্রযুক্তিতে বেশ দক্ষ ছিলেন রেদোয়ান।

রেদোয়ানের মা রহিমা খাতুন ক্যানসারে ভুগছেন আট বছর ধরে। নিজের অসুস্থতার মধ্যে ছেলের মৃত্যু দেখতে হয়েছে তাঁকে। রেদোয়ানের মৃত্যুর পর কান্না থামছে না মায়ের।

আজ শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে রেদোয়ানদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, একটি কক্ষে বিলাপ করে চলেছেন মা। তিনি বলেন, গত শুক্রবারও জুমার নামাজের পর মায়ের দেওয়া ভাত খেয়ে বাইরে যান রেদোয়ান। বাসায় বলে যান, চড়পাড়া এলাকায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছেন তিনি। সেদিন গন্ডগোলের খবরে পরিবার থেকে ফোন করা হলে রেদোয়ানের ফোন অন্য কেউ রিসিভ করে তাঁর গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানান। পরে চাচা আকরামুজ্জামন গিয়ে রেদোয়ানকে মৃত অবস্থায় পান। সেদিন রাত আটটার কিছু সময় পর একটি অ্যাম্বুলেন্সে অপরিচিত লোকজন রেদোয়ানের লাশ বাড়িতে দিয়ে যান।

রেদোয়ান নিজের ফেসবুকে ১৬ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ঘটনাবলি নিজের ফেসবুকে শেয়ার করতেন। ১৭ জুলাই নিজের ফেসবুকের প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন করে রংপুরে নিহত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবু সাঈদের ছবি দেন তিনি।

শনিবার সকাল ১০টার দিকে জানাজা শেষে আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টার কবরস্থানে দাফন করা হয় রেদোয়ানকে। রেদোয়ানের বাবা তাঁদের ভিটায় বছরখানেক আগে নতুন একটি দালান তুলেছেন। সেটিতে রেদোয়ানের বাকি জীবন কাটবে, এমন ভাবনা ছিল বাবার। বাসার যে কক্ষে রেদোয়ান থাকতেন, সেখানে বসে কথা হয় বাবা আসাদুজ্জামান ও চাচা আশরাফুজ্জামানের সঙ্গে। খাটের পাশেই ঘুমিয়ে ছিল রেদোয়ানের আদরের বিড়াল। খাটের পাশে ট্রাঙ্কের ওপর ছড়িয়ে ছিল তাঁর বইপত্র।

নিহত রেদোয়ান হাসান ওরফে সাগর
ছবি: সংগৃহীত

আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ছেলেকে ঘিরেই অনেক স্বপ্ন ছিল। ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবে, আশা করতাম। এক বছর হলো নতুন ঘর করেছি। ঘরে কে থাকবে এখন, ঘরে বাতি দেওয়ার তো কেউ রইল না।’ বলেই চোখের পানি মুছতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমার সব এলোমেলো হয়ে গেছে এখন। ঘর করার সময় ভেবেছিলাম স্ত্রী মারা যাবে, কিন্তু সে রয়ে গেছে। ঘরের যে মালিক, সে–ই চলে গেছে। আমার কোনো ক্ষোভ নেই, দুঃখ করি না। হায়াত থাকলে কোনো না কোনোভাবে আমার ছেলে বেঁচে ফিরত।’

রেদোয়ানের বুকের বাঁ পাশে ও পিঠের ডান পাশে দুটি ছিদ্রের মতো ছিল বলে জানিয়েছেন বাবা আসাদুজ্জামান। মরদেহ বাড়িতে নেওয়ার পর তা দেখেন তিনি।

ছেলে মারা গেছেন কোনো আক্ষেপ নেই, তবে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতিতে যেন কাউকে না পড়তে না হয়, সে দাবি জানান আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। আমার ছেলের রক্তের বদলে দেশে শান্তি ফিরে আসুক।’

চাচা আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘রেদোয়ান আমাদের বংশের প্রথম সন্তান। আমাকে বাবা বলে ডাকত, আমিও সন্তানের মতো তাকে আদর করতাম। এখন আমাদের ঘরটি পুরোই ফাঁকা।’ মামলা করেননি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলা করে কী হবে? যে জিনিস গেছে, তা তো আর ফিরে আসবে না।’