ইতালি যাওয়ার আগে ভূমধ্যসাগরে প্রাণ গেল সুনামগঞ্জের দুই তরুণের

লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে মারা যাওয়া সুনামগঞ্জের দুই তরুণ শাহিবুর রহমান (বাঁয়ে) ও রেজাউল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন শাহিবুর রহমান ওরফে মান্না (২২)। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার ছোট ছেলের আবদার ও জিদ রক্ষায় সবকিছু খুইয়ে তাঁকে পাঠায় লিবিয়ায়। সেখান থেকে ১০ মাস পর সাগরপথে ইতালিতে যাওয়ার নৌকায় (গেম) ওঠার সুযোগ পান তিনি। এর এক দিন আগে মা-বাবা, ভাইবোনদের সঙ্গে শেষবার কথা বলেন শাহিবুর। খুশিমনে সবাই অপেক্ষায় থাকেন তাঁর ইতালিতে পৌঁছার খবর শোনার জন্য; কিন্তু এই খুশির বদলে দুঃসংবাদ আসে। ইতালিতে পৌঁছার আগেই ভূমধ্যসাগরে মারা গেছেন শাহিবুর।

শুধু শাহিবুর নন, একই নৌকায় ছিলেন সুনামগঞ্জের আরেক তরুণ রেজাউল ইসলাম (২৪)। তিনিও মারা গেছেন। দুই তরুণের বাড়িতে এখন মাতম চলছে। কীভাবে, কোথায় তাঁরা মারা গেলেন, এসবের বিস্তারিত এখনো জানা যায়নি। শুধু নৌকায় থাকা সুনামগঞ্জের অন্যরা ফোনে এই দুই তরুণের মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করেছেন। তবে লাশটি যেন শেষবারের মতো পরিবারের সদস্যরা ছুঁয়ে দেখতে পারেন, এই আকুতি তাঁদের।

আরও পড়ুন

শাহিবুর রহমানের বাড়ি সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার শিমুলবাক ইউনিয়নের তলের বন গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুল ওয়াহাব। রেজাউল ইসলামের বাড়ি জেলার ছাতক উপজেলার জাউয়া বাজার ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম সুন্দর আলী।

শাহিবুরের বড় ভাই শাহিবুল ইসলাম জানান, শাহিবুর বিদেশে যাওয়ার জন্য ‘পাগল’ ছিলেন। গ্রামের আরও দু-একজন এভাবে ইতালিতে গেছেন। তাঁদের মাধ্যমেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উজ্জ্বল আহমদ নামের এক দালালের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এরপর সাড়ে আট লাখ টাকায় রফা হয়। এই টাকা দিয়ে ১০ মাস আগে শাহিবুর লিবিয়ায় যান। এরপর শুরু হয় ‘গেমের’ (সাগরপথে চূড়ান্ত যাত্রা) জন্য অপেক্ষা। বাড়ি থেকে মাসে মাসে খরচের টাকা পাঠানো হতো। বাবা কৃষিকাজ করেন। এক ভাই চালান অটোরিকশা। তবুও ছোট ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে খেয়ে না খেয়ে টাকা পাঠাতেন তাঁরা। একপর্যায়ে দালাল জানান, আরও এক লাখ টাকা না দিলে ‘গেমে’ তোলা হবে না। এরপর সুদে টাকা এনে পাঠান তাঁরা। গত শুক্রবার লিবিয়া থেকে ‘গেমে’ ওঠানো হয় শাহিবুরকে।

আরও পড়ুন

শাহিবুল বলেন, ‘খবরটা শোনার পর থাকি বাড়িত আম্মা-আব্বা পাগল অইগিছইন। আমরা তো এমনি শেষ। এখন ভাইটারেও হারাইলাম। আম্মায় ভাইয়ের মুখটা শেষবার দেখতা ছাইন।’

শিমুলবাক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. শাহিনুর রহমান বলেন, ‘শাহিবুলের পরিবার পক্ষ থেকে আমাকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে লাশ দেশে আনা যায়, সেটির উদ্যোগ নেব।’

রেজাউল ইসলামের বাবাও কৃষক। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্য রেজাউল ইসলাম সবার ছোট। বড় দুই ভাই আছেন ওমানে। এক বছর আগে রেজাউল প্রথমে দুবাই, পরে মিসর হয়ে যান লিবিয়ায়। ২১ জুন রেজাউল ফোনে জানান, তিনি লিবিয়া থেকে ইতালিতে যাওয়ার ‘গেমে’ উঠছেন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ওমান থেকে তাঁর বড় ভাই নজরুল ইসলাম ফোনে রেজাউলের মৃত্যুর খবরটি জানান।

আরও পড়ুন

দেশে থাকা ফুফাতো ভাই ইমরান আহমদ নজরুলের বরাত দিয়ে জানান, ওই ‘গেমে’ সুনামগঞ্জের আরও লোক ছিলেন। তাঁরাই ইতালিতে পৌঁছার পর হোয়াটসঅ্যাপে নজরুল ইসলামকে জানান, তাঁরা ইতালিতে পৌঁছেছেন। তবে পথে অসুস্থ হয়ে রেজাউল ও শাহিবুর মারা গেছেন। ইতালিতে পৌঁছার পর তাঁদের বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। রেজাউল ও শাহিবুরের লাশ কোথায় রাখা হয়েছে, তাঁরা সেটি জানেন না।

ইমরান আহমদ জানান, ইতালিতে তাঁদের আত্মীয়স্বজন আছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে খোঁজ নিচ্ছেন। রেজাউলের বাবা বৃদ্ধ। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। তিনিই ইউপি চেয়ারম্যানের প্রত্যয়ন নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বিষয়টি জানিয়েছেন।

ছাতকের ইউএনও গোলাম মুস্তাফা আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেছেন, রেজাউল ইসলামের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি আবেদনটি পেয়েছেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবেন।

আরও পড়ুন