লোহাগড়ার সাহাপাড়ায় যেভাবে হামলা

সোমবার থেকে দিঘলিয়া বাজারের সব দোকান খুলেছে। সাহাপাড়ার বাসিন্দারাও বাড়িতে ফিরে এসেছেন।

  • পুলিশ গত রোববার দিনে ও রাতে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। সোমবার গ্রেপ্তার হয়েছেন আরেকজন।

  • এ ঘটনায় সোমবার জেলা পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসক পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।

‘সন্ধ্যার পরপর বিদ্যুৎ চলে যায়। পুরো পাড়ায় নেমে আসে অন্ধকার। এমন সময়ে শোরগোল, আশপাশের বাড়িতে চিৎকার-চেঁচামেচি। ভয়ে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিই। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকজন এসে দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে। টিভি, ফ্রিজ ও আলমারি ভাঙচুর করে। পরিবারের সবাই এক কক্ষে দরজা আটকে ছিলাম। সেই দরজা ভাঙতে চেষ্টা করেন হামলাকারীরা। প্রায় ৪৫ মিনিট তাণ্ডব চালান। স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি ও পুলিশ এলে হামলাকারীরা দৌড়ে চলে যান।’

গত সোমবার বিকেলে প্রথম আলোর কাছে হামলার এ বর্ণনা দেন নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহাপাড়ার বাসিন্দা পলাশ সাহা। পেশায় স্কুলশিক্ষক পলাশ আরও বলেন, ‘ওই সময়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি ও পুলিশ না এলে কী যে হতো, তা কল্পনা করতে পারছি না!’

ধর্ম অবমাননা করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে দিঘলিয়ার সাহাপাড়ায় পলাশ সাহাদের বাড়িসহ আরেকটি বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়। আগুন দেওয়া হয় গোবিন্দ সাহার বাড়িতে। এ সময় চারটি মন্দিরেও হামলা করা হয়। দিঘলিয়া বাজারের তিনটি দোকানে চড়াও হন হামলাকারীরা।

ওই সময়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি ও পুলিশ না এলে কী যে হতো, তা কল্পনা করতে পারছি না!
পলাশ সাহা, দিঘলিয়া গ্রামের সাহাপাড়ার বাসিন্দা

এ ঘটনায় পুলিশ গত রোববার দিনে ও রাতে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। সোমবার গ্রেপ্তার হয়েছেন আরেকজন। ছয়জনেরই তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। লোহাগড়া আমলি আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোরশেদুল আলম ওই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। সোমবার থেকে দিঘলিয়া বাজারের সব দোকান খুলেছে। বাড়িতে এসেছেন সাহাপাড়ার বাসিন্দারা।

সাহাপাড়ার রাধাগোবিন্দ মন্দিরের সভাপতি শিবনাথ সাহা বলেন, ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে জানাজানি হয়। এর কিছুক্ষণ পর ১৫০ থেকে ২০০ তরুণ দিঘলিয়া বাজারের কাছে তাঁর বাড়িতে আসেন। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া তরুণের বিচার দাবি করেন। এরই মধ্যে হাজির হন লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আজগর আলী ও ৮-১০ জন পুলিশ সদস্য।

বিচারের আশ্বাস দেওয়ায় সবাই চুপচাপ হয়ে যান উল্লেখ করে ইউএনও বলেন, ‘আমি এলাকায় অবস্থান করতে থাকি। অভিযুক্ত তরুণ পালিয়ে যায়। ওই তরুণের বাবাকে নিরাপত্তা দিতে সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে তাঁকে নিয়ে লোহাগড়ার দিকে রওনা হই। লোহাগড়া প্রায় পৌঁছে গেছি, এমন সময়ে খবর পাই, বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে। ফিরে আসি। এ সময়ে ৫০০ থেকে ৭০০ বিক্ষুব্ধ লোক মিছিল করছিলেন। এ অবস্থায় তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছোড়েন। এরই মধ্যে একটু দূরে সাহাপাড়ায় হামলার কথা শোনা যায়।’ তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ এসে অল্প সময়ের মধ্যে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

হামলাকারীরা কারা ছিলেন, এমন প্রশ্নে ইউএনও বলেন, ‘মামলা হয়েছে, তদন্তে সব বের হয়ে আসবে। এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাই না।’

দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জন্ম দেওয়া এ হামলার ঘটনায় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তাঁরা বলছেন, গোবিন্দ সাহা ফুটপাতের পান বিক্রেতা। গরিব মানুষ। তাঁর বাড়িতে কারা আগুন দিলেন, কী ছিল উদ্দেশ্য? হামলা হয়েছে স্কুলশিক্ষক পলাশ সাহা ও তাঁর ভাই দিঘলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিলীপ চন্দ্র সাহার একান্নবর্তী বাড়িতে। এ বাড়িইবা কেন অক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হলো? মন্দিরে কারা হামলা চালালেন?

গোবিন্দ সাহা ও তাঁর মা দিপালী সাহা হামলার ব্যাপারে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। মন্তব্য করতে রাজি নন দিলীপ সাহাও।

স্থানীয় কয়েকজনসহ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, হামলার ক্ষেত্রে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধন থাকতে পারে। এ ছাড়া দুর্বৃত্তরা এর সুযোগ নিয়ে হয়তো জিনিসপত্র লুট করতে চেয়েছিলেন। প্রশাসনের তৎপরতায় তা পেরে ওঠেনি।

গতকাল মঙ্গলবার সাহাপাড়ায় হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ঘুরে দেখেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য; জাতীয় সংসদের হুইপ পঞ্চানন বিশ্বাস এবং সংসদ সদস্য বীরেন শিকদার, মনোরঞ্জন শীল গোপাল, অসীম কুমার উকিল ও পঙ্কজ দেবনাথ। তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজাও ছিলেন।

বিকেলে লোহাগড়া উপজেলা মিলনায়তনে মতবিনিময় সভা হয়।

এ ছাড়া গতকাল দুপুরে বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুস সাত্তার, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রমুখ সাহাপাড়া পরিদর্শন করেন। এদিকে এ হামলার ঘটনায় গত সোমবার রাতে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে এই ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হলো।