করিমগঞ্জে রবি দাস সম্প্রদায়ের এক তরুণের মৃত্যু নিয়ে যা জানা গেল
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে রবি দাস সম্প্রদায়ের হৃদয় রবি দাস নামে এক তরুণের মৃত্যু নিয়ে নানা ধরনের ভাষ্য পাওয়া গেছে। শনিবার ভোরে করিমগঞ্জে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজে তিনি মারা যান। হৃদয় রবি দাস (২১) করিমগঞ্জের জয়কা বারুক বাজার এলাকার রিকশাচালক জুগেস রবি দাসের দ্বিতীয় ছেলে।
স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, হৃদয় উপজেলার নোয়াবাদ ভূঁইয়া বাজার এলাকায় একটি সেলুনে নরসুন্দরের কাজ করতেন। কিছুদিন আগে একই এলাকার একজন এতিম মুসলিম কিশোরীর (১৬) সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ নিয়ে কিশোরীর স্বজনদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় হৃদয়ের বাড়ি জয়কা থেকে কর্মক্ষেত্র ভূঁইয়া বাজার সেলুনে গেলে ওই মুসলিম কিশোরীর স্বজনসহ কয়েকজন হৃদয় ও তাঁর চাচাতো ভাই শাকিল রবি দাসকে ডেকে বাজারের ক্লাবঘরে নিয়ে যান। সেখানে নোয়াবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, বাজার কমিটির সভাপতি মঞ্জিল মিয়াসহ পাঁচ-ছয়জন উপস্থিত ছিলেন। প্রায় এক ঘণ্টা তাঁদের ক্লাবে আটকে রেখে নানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
শাকিল রবি দাস বলেন, ‘সন্ধ্যা ছয়টায় দুজন মিলে একসঙ্গে বাড়ি থেকে নোয়াবাদ এলাকার ভূঁইয়া বাজারে যাই। সেখান থেকে বাজারের ক্লাবে আমাদের দু-তিনজন ধরে নিয়ে যায়। নোয়াবাদ ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর মিয়া, বাজার কমিটির সভাপতি মঞ্জিল মিয়াসহ মুসলিম কিশোরীর দু-তিনজন স্বজন উপস্থিত থেকে আমাদের মুঠোফোন কেড়ে নেয় এবং নানা জিজ্ঞাসাবাদ করে মারপিট করে। ঘণ্টাখানেক পর তিনজন চৌকিদার, একজন স্থানীয় লোকসহ আমাদের অটোরিকশায় করে সেনাক্যাম্পে পাঠায়। অটোরিকশায় করে নিয়ে যাওয়ার সময়ও মারধর করা হয় আমাদের। সেনাক্যাম্পে গেলে হৃদয়কে এক কক্ষে ও আমাকে আরেক কক্ষে রাখা হয়। হৃদয়ের কক্ষে কী ঘটনা ঘটেছে, আমি জানতে পারিনি। পরে রাত দুইটার দিকে দেখি, হৃদয়কে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে হৃদয় মারা যায়।’
আজ রোববার বিকেলে শাকিলের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর বাঁ হাত ও ডান ঊরুতে মারধরের দাগ ও তাঁর পরনের লুঙ্গিতে রক্তের দাগ দেখা যায়। এমন সময় তাঁর চোখমুখে আতঙ্ক ছিল। তিনি আর কিছু বলতে চাননি।
তবে চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, শুধু হৃদয়ের মুঠোফোন চেক করে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে করিমগঞ্জে সেনাক্যাম্পে খবর দেওয়া হয়। কারণ, হৃদয়ের মুঠোফোন হোয়াটসঅ্যাপে কিশোরীর বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। পরে তিনজন চৌকিদার, একজন স্থানীয় বাসিন্দাসহ একটি রিকশায় হৃদয় ও শাকিলকে করিমগঞ্জ উপজেলা কার্যালয়ের সেনাক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে শুক্রবার রাত দুইটার দিকে খবর পান যে হৃদয় খুব অসুস্থ।
হৃদয়ের বাবা জুগেস রবি দাস বলেন, ‘শহর থেকে প্যাডেল রিকশা চালিয়ে আমি প্রায় ১০টার দিকে বাড়ির পাশে বাজারে গেলে শুনতে পাই, সেনাক্যাম্পে আমার ছেলেকে নেওয়া হয়েছে। এ কথা শুনে ছেলের মা–সহ আমরা সবাই করিমগঞ্জের সেনাক্যাম্পে ছুটে যাই। সেনাসদস্যদের অনুরোধ করে বলি, স্যার, আমার ছেলেটাকে দেখান। তারা দেখতে দেয়নি। বলে, কাল থানায় চালান দিলে দেখবেন। এরপরও আমরা ক্যাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রায় দুই ঘণ্টা পর দেখি, আমার ছেলেকে ক্যাম্প থেকে বের করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। আমরা পাশে যেতে পারিনি। রাত প্রায় তিনটার দিকে বাড়ি ফিরে আসি। পরে শনিবার সকাল আনুমানিক ছয়টার দিকে বাড়ির একটি মোবাইল নম্বরে এক কর্মকর্তা জানায় যে হৃদয় খুব অসুস্থ। এখনই সবাইকে হাসপাতালে যেতে হবে। হৃদয়ের মা–সহ সবাই হাসপাতালে গিয়ে দেখি, হৃদয়ের নিথর দেহ পড়ে আছে। পরে শনিবার বিকেল চারটার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে হৃদয়ের লাশ বাড়িতে পাঠানো হয়। রাত ১১টার দিকে পাশের খুদারগাও ভাটোয়া শ্মশানে মাটি দেওয়া হয় হৃদয়কে।’ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এলে এ বিষয়ে মামলা করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
বিষয়টি জানতে করিমগঞ্জের সেনাক্যাম্পে গেলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, হৃদয়কে গণপিটুনি দিয়ে স্থানীয় লোকজন তাঁদের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে এক কিশোরীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্মান্তরিত ও অন্যত্র পাচার করে দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে তাঁর মুঠোফোনে অনেক তথ্য ছিল। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় তাঁকে অনেক রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ হৃদয় অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় তাঁর মুখ থেকে নেশাজাতীয় একধরনের দ্রব্যের গন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়া জনগণের পিটুনি ও সেনাসদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ—সব মিলিয়ে হৃদয় অসুস্থ হয়ে গেলে তাঁকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নেওয়া হয়। সেখানে হৃদয় মারা যান। হৃদয় হয়তো নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের কারণে, না হয় হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। তবে ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা প্রতিবেদন এলে মৃত্যুর আসল কারণ জানা যাবে। তবে সেনাসদস্যদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে হৃদয়কে সুস্থ করে তুলতে এবং হৃদয়ের সঙ্গে আর কারা জড়িত ছিল, সে বিষয়ে জানতে।
এ ব্যাপারে আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, রাত সোয়া দুইটার দিকে সেনাসদস্যরা হৃদয়কে নিয়ে হাসপাতালে আসেন। এখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘণ্টাখানেক পর মারা যান। হৃদয়ের শরীরে মারধরের চিহ্ন ছিল।