জামালপুরে জমজমাট জামাই মেলা, রমজানে বিক্রি কম বলছেন ব্যবসায়ীরা

মেলায় নানা বয়সী দর্শনার্থীর ভিড় দেখা গেছে। শিশুদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সোমবার দুপুরে জামালপুর সদর উপজেলার গোপালপুর বাজার এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

জামালপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশেই গোপালপুর বাজার। সেখানে আশপাশের বিশাল এলাকাজুড়ে বসেছে মেলা। গোপালপুর-নরুন্দি সড়কের দুই পাশসহ পুরো মেলা চত্বরে বসেছে বিভিন্ন পণ্যের পসরা। ছোট্ট এক শিশু বাবার হাত ধরে দ্রুতগতিতে মেলার ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পাশ থেকে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলে উঠলেন, ‘নামে জামাই ম্যালা হইলেও এনে সবচেয়ে বেশি মজ-মাস্তি করে করে পোলাপানেরাই (শিশুরা)।’

জামালপুরের গোপালপুর ‘জামাই মেলা’ গত শনিবার শুরু হয়েছে, চলবে আগামী বুধবার পর্যন্ত। এবার রমজান মাসে আয়োজিত হলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার কোনো কমতি নেই। সোমবার গিয়ে দেখা যায়, এ মেলা কেন্দ্র করেই আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় এখন বইছে উৎসবের আমেজ।

প্রতিবছর ১-৫ চৈত্র (সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে) সদর উপজেলার ঝাওলা গোপালপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় মাঠ ও এর আশপাশে এই মেলা বসে। একে কেন্দ্র করে এলাকার জামাইয়েরা শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে আসেন। এ কারণেই মেলাটি ‘জামাই মেলা’ হিসেবে পরিচিত। আর জামাইয়েরাই মেলার মূল আকর্ষণ। পাঁচ দিনের এই মেলায় সদর উপজেলার গোপালপুর, নরুন্দি, ঘোড়াধাপ, ইটাইল, বাঁশচড়া, তুলসীরটর, লক্ষ্মীরচর, রানাগাছা ও প্রতিবেশী ময়মনসিংহের চেচুয়া এলাকাসহ আশপাশের লাখো মানুষের সমাগম ঘটে।

রমজান মাস সকালে মেলায় তুলনামূলক কম লোকজন থাকলেও তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, গভীর রাত পর্যন্ত শিশু, নারী-পুরুষের ব্যাপক ভিড় থাকে। জামাইদের সবচেয়ে বেশি ভিড় চোখে পড়ে দুপুরের ঠিক পরপর।

মেলায় শিশুদের বিনোদনের কেন্দ্র
ছবি: প্রথম আলো

মেলায় প্রসাধনী, খাবার, খেলনা, মিঠাই-মিষ্টান্ন, মাছ, ফার্নিচারসহ বিভিন্ন ধরনের পাঁচ শতাধিক দোকান আছে। আছে চটপটি-ফুচকা থেকে মুখরোচক নানা পদের খাবারের দোকানও। শিশুদের বিনোদনের জন্য আছে নাগরদোলা, চরকি, দোলনাসহ নানা আয়োজন। সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন সাইজের ছোট-বড় মিষ্টি। এ ছাড়া বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে আছে বালিশ মিষ্টি। এসব মিষ্টি জামাইয়েরা কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যান।

তবে এই মেলার উৎপত্তি নিয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারেননি কেউ। আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা যায়, যুগ যুগ ধরে এই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে গোপালপুর বাজারে একটি বিশাল বটগাছ ছিল। ওই বটগাছের নিচে বারুণী স্নান উপলক্ষে হিন্দুসম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ জড়ো হতেন। তখন ওই বটগাছের নিয়ে মেলায় হতো। এরপর চৈত্র মেলা হিসেবে ব্রিটিশ আমলে শুরু হলেও এখন এটি জামাই মেলা হিসেবে পরিচিত।

মেলা থেকে মিষ্টান্ন কিনছেন ক্রেতা
ছবি: প্রথম আলো

এলাকার মানুষের কাছে মেলাটি ঈদ বা পূজা-পার্বণের মতোই উৎসবের আরেক নাম। মেলা উপলক্ষে গোপালপুর ও এর আশপাশের বিবাহিত মেয়েরা তাঁদের স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসেন। আর জামাইকে মেলা উপলক্ষে বরণ করে নেওয়ার জন্য শ্বশুর-শাশুড়িরা বেশ আগে থেকেই প্রস্তুতি নেন। মেলার দিন জামাইয়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দেন শাশুড়িরা। আর সেই টাকার সঙ্গে আরও টাকা যোগ করে জামাইয়েরা মেলা থেকে চিড়া, মুড়ি, মিষ্টি, জিলাপি, বড় বড় মাছসহ বিভিন্ন জিনিস কিনে বাড়ি ফেরেন।

মেলায় কথা হয় গোপালপুর এলাকার আড়িলিয়া গ্রামের নরুল ইসলাম নামের এক প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মেলায় ঈদের মতো বাড়িতে ভালোমন্দ খাইদ্য রান্না হয়। তিন জামাতাকে ২ হাজার করে টাকাও দিয়েছি। তারা ওই টাকার সঙ্গে আরও টাকা দিয়ে মেলা থেকে বিভিন্ন খাবার ও মাছ কিনে বাড়িতে নিয়ে গেছে।’

ক্রেতার দেখা না পেয়ে অলস বসে ছিলেন এক বিক্রেতা
ছবি: প্রথম আলো

গোপালপুর এলাকার বৈঠামারী গ্রামের জামাই শিপন মিয়া জানান, এই মেলা তাঁর কাছে বার্ষিক একটি আকর্ষণ। সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। মেলার কারণে একটি মিলনমেলায় পরিণত হয় গোপালপুর ও আশপাশের গ্রাম।

মেলা ঘিরে ঈদের মতোই আনন্দ করা হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা রতন মিয়া।
প্রায় ৮ বছর ধরে এই মেলায় বিভিন্ন রকমের আচার আনেন বলে দাবি করেন ময়মনসিংহ থেকে আসা আচার ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন। তিনি বলেন, এতে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। অনেক ক্রেতার সঙ্গে পরিচিতি হয়ে গেছে। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এবার রমজান হওয়ার কারণে বিক্রি কম। সারা জেলার মানুষ মেলায় আসছেন। তবে এবার রমজানের কারণে লোকজন কম।

মেলা আয়োজক কমিটির সদস্য মো. গোলাম রব্বানী বলেন, ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনায় মেলা জমে উঠেছে। বিশেষ করে ইফতারের পর নারী-পুরুষ ও শিশুদের ঢল নামে। আশা করছেন, মেলাটি সুন্দরভাবেই শেষ হবে।