গোমতীর বাঁধ ভেঙে বসতবাড়িতে ‘পুকুর’, বন্যার স্মৃতি মনে করে আঁতকে ওঠেন বাসিন্দারা
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে আশপাশে বিশাল আকৃতির গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে কিছুদিন আগেও মানুষের ঘরবাড়ি ছিল। বন্যার পানি নেমে ওই এলাকায় ক্ষতচিহ্ন বেরিয়ে এসেছে। গোমতীর বেড়িবাঁধের ভাঙন দেখলে বন্যার কথা মনে করে এখনো ভয়ে আঁতকে উঠছেন বাসিন্দারা।
বুড়বুড়িয়া বাঁধের পাশের বাড়িটি গোলাম মোস্তফার। তীব্র স্রোতে নিজের দুটি এবং তাঁর ভাই গোলাম কিবরিয়ার একটি ঘর ভেসে গেছে। গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরার সব শেষ হইয়া গেছে। ২২ আগস্ট রাইত থাইক্যা গোমতীর আইলের (বেড়িবাঁধ) ওপর থাকতাছি। মাথার ওপরে ত্রিপল, বৃষ্টি আইলে ভিজ্জা যাই। অহন আর কেউ আমরার খোঁজ নেয় না। আমার ভাইডার ঘরও শেষ। আমরা এহন নিঃস্ব।’
গত ২২ আগস্ট রাত পৌনে ১২টার দিকে বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে স্রোতের মতো পানি প্রবেশ করতে থাকে লোকালয়ে। ভারত থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা বৃষ্টিতে গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় কারণে ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। গোমতীর বাঁধভাঙা সেই স্রোতে মুহূর্তের মধ্যেই ভেসে যায় পুরো বুড়িচং উপজেলা। পাশের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলাও পরবর্তী দুই দিনের মধ্যে প্লাবিত হয়ে যায়। এ ছাড়া এই ভাঙা বাঁধের পানি বুড়িচং হয়ে প্রবেশ করে দেবীদ্বারেও। তীব্র স্রোতে বানের পানি প্রবেশের ফলে তলিয়ে যায় মানুষের ঘরবাড়ি, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যোগাযোগব্যবস্থা।
গত ২৭ আগস্ট রাত থেকে গোমতীর পানি বিপৎসীমার নিচে নামতে শুরু করে। তবে এরপরও ওই ভাঙা বাঁধ দিয়ে অনবরত পানির স্রোত যাচ্ছিল লোকালয়ে। এরই মধ্যে ভাঙন এলাকায় ও আশপাশে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল আকৃতির গর্তের; যা দেখতে পুকুরের মতো। যেখানে কিছুদিন আগেও ছিল মানুষের সাজানো-গোছানো সংসার। কিন্তু বর্তমানে সেখানে গেলে মনেই হবে না যে এখানে কয়েক দিন আগেও বাড়িঘরের অস্তিত্ব ছিল।
গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে বুড়বুড়িয়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভাঙন এলাকায় পুকুর আকৃতির গর্তে পানি জমে আছে। ওই এলাকার কিছু অংশে ক্ষতচিহ্ন ভাসা দিয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন ওই ভাঙা বাঁধ দেখতে আসছেন।
পানি কমে আসায় দ্রুত বাঁধটি মেরামতের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। তাঁরা বলছেন, দ্রুত বাঁধটি নির্মাণ করা না হলে ভারত থেকে ফের ঢল এলে যেকোনো সময় প্লাবিত হতে পারে বুড়িচং। এমন আশঙ্কায় আতঙ্কে দিন কাটছে নদীপারের মানুষের। বুড়বুড়িয়া এলাকায় বাঁধ ভাঙা থাকায় বেড়িবাঁধ সড়কটি দিয়েও গত ২২ আগস্ট থেকে যান চলাচল বন্ধ আছে। বেড়িবাঁধ সড়কটি দিয়ে কুমিল্লা শহর থেকে বুড়িচং সদর এবং কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের রামপুর এলাকায় চলাচল করা যেত সহজে। এখন দীর্ঘ পথ ঘুরে স্থানীয় লোকজনের চলাচল করতে হচ্ছ।
সরেজমিনে দেখা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের জন্য প্রাথমিক জরিপের কাজ করছেন। সেখানে বুড়িচং উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সোনিয়া হকও উপস্থিত ছিলেন।
সোনিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের বোর্ডের লোকজন এখানে এসেছে বাঁধটির কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, সেটি নির্ণয় করে দেখতে। আমরা তাঁদের সহযোগিতা করছি। বর্তমানে ভাঙা বাঁধটি দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে না। এ জন্য বাঁধ মেরামতের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে তারাই (পাউবো) ভালো বলতে পারবেন।’
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দিন বলেন, গত ২২ আগস্ট রাতে বাঁধটি যখন ভেঙেছিল, তখন সেটি ছিল ৮-৯ মিটারের মতো। তীব্র স্রোতে নদীর পানি প্রবেশ করায় এই বাঁধটির ভাঙনের পরিমাণ এখন ১১০ মিটার বা ৩৬০ ফুটের বেশি। বাঁধটির কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এবং মেরামতে কী পরিমাণ অর্থ লাগবে, সেটি নির্ণয় করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেবেন তাঁরা। এরপর বরাদ্দ এলে মেরামতকাজ শুরু হবে। শুধু বাঁধই নয়, পানির তীব্র স্রোতে বেড়িবাঁধের দুই পাশ ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
বুড়বুড়িয়া এলাকায় ভেঙে যাওয়া বাঁধটি দেখতে এসেছেন বুড়িচংয়ের আরাগ আনন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘পানি কমেছে শুনে বাঁধটি দেখতে এসেছি। দেখেই ভয় লেগেছে। এই বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর লোকালয়ে যাওয়া স্রোত যেন আরেকটি নদী তৈরি করেছে। এখান দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় আমার বাড়িতেও কোমরসমান পানি হয়েছিল। গত কয়েক দিনে বাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে। এখন দ্রুত বাঁধটি মেরামত করা না হলে যেকোনো সময় আবার ঢলের পানি এলে লোকালয়ে ঢুকবে। তা ছাড়া এই বেড়িবাঁধ সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় চলাচলে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ।’
স্থানীয় বাসিন্দা দুলাল মিয়া বলেন, আশপাশের বেশ কয়েকটি বাড়িঘর ভেসে গেছে বানের স্রোতে। বাঁধ লাগোয়া তিন-চারটি বাড়ির এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। সেখানে এখন বড় বড় পুকুর। বাঁধ মেরামতের সময় ওই গর্তগুলো ভরাট করে মানুষকে তাঁদের বসতভিটা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান তিনি। না হলে এই বাড়িগুলোর অন্তত ১০টি পরিবারকে রাস্তার ওপর থাকতে হবে বলে জানান দুলাল।