যে কারণে সন্দ্বীপ চ্যানেলে ইলিশ কমছে

জেলেরা মাছ ধরে আনলেই ইলিশ কিনতে ঘাটে ভিড় করেন ক্রেতারা। গত মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা নৌঘাট এলাকায়প্রথম আলো।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সন্দ্বীপ চ্যানেল ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় প্রতিবছর ইলিশ আহরণের পরিমাণ কমছে। চলতি বছর ইলিশের মৌসুম প্রায় শেষ। এ মৌসুমে গতবারের তুলনায় অন্তত ৪০০ মেট্রিক টন ইলিশ কম ধরা পড়েছে। পর্যাপ্ত ইলিশ না পেয়ে হতাশ হয়ে সাগর থেকে ফিরছেন জেলেরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উজান থেকে নেমে আসা মিঠাপানির প্রবাহ ও গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন, পরিবেশদূষণ ও জলবায়ুর প্রভাবে সন্দ্বীপ চ্যানেলে ইলিশ কমে যাচ্ছে।

মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ইলিশ ধরা পড়েছিল ১ হাজার ৪৫৫ দশমিক ৯২ মেট্রিক টন। পরের বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৩১ দশমিক ৭৫ মেট্রিক টনে। কিন্তু গত বছর সেটা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭৩৫ দশমিক ৭৩ মেট্রিক টনে। এবার আরও কমে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ২৩৩ দশমিক ৫ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছে। গড়ে প্রতিবছর ইলিশ কমেছে প্রায় ৩০০ মেট্রিক টন।

সন্দ্বীপ চ্যানেলটি বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে শুরু হয়ে মেঘনার মোহনায় গিয়ে শেষ হয়েছে। চ্যানেলটির এক পাশে সীতাকুণ্ড অন্য পাশে সন্দ্বীপ। গতকাল পর্যন্ত সন্দ্বীপ চ্যানেলে ইলিশ আহরণ করা হয়েছে ২৩৩ দশমিক ৫ মেট্রিক টন।

সরেজমিনে সীতাকুণ্ডের কুমিরা ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, সন্দ্বীপ চ্যানেল থেকে সারি সারি নৌকা খালে ঢুকছে। ইলিশ কেনার জন্য উপকূলে অপেক্ষা করছেন অন্তত ১০ জন পাইকার। তাঁদের শ্রমিকেরা নৌকা থেকে ইলিশ কিনে এনে পাইকারের কাছে রেখে যাচ্ছেন।

ভাটিয়ারি এলাকার জেলে সরদার বাদল জলদাস প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর ইলিশের মৌসুমে তিনি ১২ জন শ্রমিক রাখতেন। এবারও শুরুর দিকে তা–ই ছিল। কিন্তু সাগরে তেমন ইলিশ ধরা পড়ছে না। সে কারণে চারজনকে বিদায় করে দিয়েছেন। গতকাল তাঁর ৫০টি জালের বিপরীতে ২টি নৌকায় ৮ জন শ্রমিক কাজ করেছেন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় সাত হাজার টাকা। কিন্তু দুই নৌকায় ইলিশ বিক্রি করে পেয়েছেন পাঁচ হাজার টাকা। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ বছর তার তিন-চার লাখ টাকা ক্ষতি হবে।

ইলিশ কিনে মিরসরাই, ফেনী ও কুমিল্লা এলাকায় বিক্রি করেন পাইকার অনীল জলদাস। তিনি বলেন, তাঁর তিনজন শ্রমিক নৌকায় উঠে জেলেদের থেকে মাছ কেনার কাজ করছেন। প্রতি বেলায় তাঁদের প্রত্যেককে মজুরি হিসেবে ৩০০ টাকা করে দিতে হয়। এ ছাড়া ইলিশ সংরক্ষণের জন্য বরফ লাগে ৫০০ টাকার। সব মিলিয়ে প্রতি বেলায় তাঁর খরচ হয় দুই হাজার টাকা। কিন্তু যে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে খরচের দুই হাজার টাকাও ওঠানো কষ্টকর।

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্যবার ভরা মৌসুমে ছোট ইলিশ (২০০ গ্রাম) প্রতি কেজি বিক্রি হতো ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। অথচ এবার সেই ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। ৫০০-৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। ১ কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়।

চার কারণে কমছে ইলিশ

চারটি কারণে এ বছর ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। এর মধ্যে উজান থেকে নেমে আসা মিঠাপানির প্রবাহ ও গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন, পরিবেশদূষণ ও জলবায়ুর প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি, সাগরে ইলিশের প্রাকৃতিক আবাসস্থলে ব্যাঘাত এবং পূর্ববর্তী বছরের অতিরিক্ত আহরণকে ইলিশ কম পাওয়ার কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া সীতাকুণ্ডে শিল্পকারখানা বেশি হওয়ায় কারখানার বর্জ্যসহ নানা কারণে ইলিশের পরিমাণ কমছে।

জানতে চাইলে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর জেলেদের জালে আশানুরূপ ইলিশ ধরা পড়েনি। এদিকে মা ইলিশ সংরক্ষণের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে জোয়ার আছে আর মাত্র একটি। ইলিশের আহরণ কমে যাওয়ার বিষয়ে মৎস্য বিভাগ চিন্তিত। তবে এ নিয়ে আগে সীতাকুণ্ড তথা চট্টগ্রামে কোনো গবেষণা হয়েছে বলে তাঁর জানা নেই। এখন স্বল্পপরিসরে গবেষণার কাজ শুরু হয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ চৌধুরী বলেন, ইলিশ মূলত সামুদ্রিক মাছ। প্রজননের জন্য উপকূলের দিকে আসে। তখনই আহরণ করা হয়। ইলিশের উৎপাদন এবং কী পরিমাণ কমেছে, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ল্যান্ডিং স্টেশনগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণা করা যেতে পারে। তবে ইলিশের প্রজনন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বঙ্গোপসাগরের আশপাশের অংশীজন যেমন বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের যৌথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একই সময়ে তা পালন করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।