সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে: নতুন স্বপ্নে এগিয়ে যেতে চান মিতা রানীরা
ঢাকার ধামরাই উপজেলার গাঙ্গুটিয়া ইউনিয়নের বারবাড়িয়া গ্রাম। ১৮ নভেম্বর ২০২৪, সকাল সাড়ে ১০টা। প্রকৃতিতে শীতের আবহ তখন পুরোপুরি কাটেনি। গাছগাছালি আর প্রকৃতির মায়ায় সাজানো গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটছেন একদল নারী। গন্তব্য রিনা রানী ঘোষের বাড়ির উঠান। সেখানে গ্রামীণফোনের ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানের আওতায় আয়োজিত উঠান বৈঠকে যোগ দেবেন তাঁরা। উঠানে কাঠমল্লিকা ফুল গাছের ডালে বসা ঘুঘু পাখি ডাকছিল মিষ্টি সুরে। নানা প্রজাতির পাখির কলকাকলিতে মুখর পাশের কাঠবাগান।
এ গ্রামের পুরুষদের বেশির ভাগই চাকরিজীবী ও দিনমজুর। নারীদের অধিকাংশই গৃহিণী। তবে সাংসারিক টানাপোড়েন মেটাতে অনেক নারীই নানাভাবে ঘরে বসে আয়ের চেষ্টা করছেন। তেমনই একজন মিতা রানী কর্মকার। তাঁর স্বামী মাধব কর্মকার পেশায় দিনমজুর। স্কুল ও কলেজে পড়ুয়া দুই সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। পরিবারে আর্থিক জোগান দিতে মিতা রানী নকশিকাঁথাসহ নানা ধরনের কাঁথা সেলাই করেন। প্রতিটি সাধারণ কাঁথা সেলাই করে পান ৪০০ টাকা। গ্রামের বাজারে নকশিকাঁথার চাহিদা না থাকায় তেমনভাবে এগুলো তৈরিতে আগ্রহী হননি। তবে উঠান বৈঠকে অংশ নিয়ে মিতা রানী জেনেছেন, কীভাবে অনলাইনের মাধ্যমে নকশিকাঁথার বাজার তৈরি করা যায়। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি স্বপ্ন দেখছেন বড় পরিসরে নকশিকাঁথা সেলাইয়ের।
মিতা রানী বলেন, ‘১০-১১ বছর বয়স থেকে কাঁথা সেলাই করি। মায়ের কাছ থেকেই এ কাজ শিখেছি। ২০০৫ সালে আমার বিয়ে হয়। স্বামী স্বর্ণালংকার বানানোর কাজ করত। একসময় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এখন সে দিনমজুরের কাজ করে। একটু ভালো থাকা এবং নিজের একটা পরিচয় দাঁড় করাতেই নিজে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ শুরু করি।’ মিতা বলেন, ‘সাধারণ কাঁথা সেলাইয়ের জন্য লোকজন কাপড়, সুতা, সুই সব দিয়ে যান। আমি শুধু সেলাইয়ের কাজ করি।’
উঠান বৈঠকে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে মিতা রানী বলেন, ‘এখান থেকে আমি অনেক কিছু শিখছি। শিশুদের জন্য কাঁথা যে অনলাইনে বিক্রি করা যায়, আগে জানতাম না। আমার ছেলেও বলত, “মা, তুমি যে কাজ করো, এটা ছোট কাজ না।” উঠান বৈঠক অনুষ্ঠানে এসে জানলাম, এগুলো বিক্রি করার উপায় আছে অনলাইনের মাধ্যমে। আমার বানানো যে নকশা করা কাঁথা আছে, সেগুলো এখন অনলাইনে বিক্রি করার চেষ্টা করব।’
মিতা রানীর মতো বৈঠকে উপস্থিত অনেকেই এখন বেশ আশাবাদী। ঘরে বসে ইন্টারনেট ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি দেশ–বিদেশের তথ্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী তাঁরা। বৈঠকে উপস্থিত গৃহিণী তানিয়া আক্তার বলেন, ‘এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে ব্যবসা করা, পত্রিকা পড়া, প্রয়োজনীয় তথ্য খোঁজার বিষয়গুলো জানতে পারলাম। বুঝতে পেরেছি, যেসব নারী বাড়িতে থাকেন, তাঁরাও চাইলে দেশ–বিদেশে নিজের চিন্তা ও হস্তশিল্প ছড়িয়ে দিতে পারবেন। আমি নিজেও আগ্রহ পাচ্ছি নতুন কিছু করার।’
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী আরেকজন নারী রিনা রানী ঘোষ বলেন, ‘আমার বাবা ঘি বানান। আমি সেই ঘি আইনা অনেককেই দেই। এখন দেখি মোবাইল দিয়াও বেচা যায়। ভাবতেছি, খাঁটি ঘি আইনা অনলাইনে বেচব।’
মিতা রানী, তানিয়া আক্তার ও রিনা রানী ঘোষের মতো অসংখ্য গ্রামীণ নারীর বিভিন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোগ শুরু করতে সাহস ও উৎসাহ জোগানো, ইন্টারনেটে তথ্য খোঁজ (সার্চ) করার কৌশল শেখানো এবং স্বাস্থ্যসচেতন করার এই প্রচারাভিযানের নাম ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’। এর লক্ষ্য, ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখার মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা যাতে জীবনের চলার পথের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারেন। আয়োজনটি সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় গতকাল সোমবার (৯ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ১ হাজার ৯৮০টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।
ধামরাই উপজেলায় উঠান বৈঠকের কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুসভার চার সদস্যের একটি দল। অনুষ্ঠান শুরুর আগে ইউনিয়ন ঘুরে স্থানীয় সহায়তাকারী নির্বাচন এবং জায়গা নির্ধারণের কাজ করেন তাঁরা।