পথে পথে ওস্তাদের গান গেয়ে সংসার চলে শিষ্যের
পথে পথে ওস্তাদ সাইদুলের কিচ্ছা গেয়ে এখন শিষ্য বাবুল হোসেনের সংসার চলে। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নেচে নেচে গানের সুরে কষ্টের কথা থাকে সেই গানে। গান শুনে মনে হয়, শিল্পীর বুকের ভেতর থেকে কান্না ঝরে পড়ছে।
কয়েক দিন আগে বাবুল হোসেনের দেখা পাওয়া গেল রাজশাহী নগরের বিমান চত্বরে। তাঁর মুখে মেকআপ, মাথায় লাল ফিতা, গায়ে রঙিন কুর্তি আর কোমরে ওড়না বাঁধা। তিনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে কোমর দুলিয়ে নেচে নেচে গাইছিলেন। শুরুতে যে বন্দনা গাইলেন, সেটা থেকে বোঝা গেল, ছয় সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ তাঁকে একাই করতে হয়। তাঁর ওস্তাদের নাম সাইদুল ইসলাম।
এরপর বাবুল হোসেন কিচ্ছার প্রেম পর্বের একটি গান করলেন। সেখানে নর-নারীর সহজাত প্রেমের কথা বললেন। এর সুর ও তাল আগের থেকে একেবারে আলাদা। তিনি গাইলেন, ‘ওই লিছুর বাগানে দিয়েছিলাম পাও, সখিরে লিচুয়ে ঘিরে নিল আমার গাও। সখিরে বায়ে-বাতাসে না জুড়াল গাও। সখিরে অঞ্চল তুলিয়া মুছে দাও গাও। আমের বাগানে দিয়েছিলাম পাও। সখিরে পাতায়ে ঘিরে নিল আমার গাও। বায়ে-বাতাসে না জুড়াল গাও। সখিরে ওড়না দিয়ে মুছে দাও গাও।’
হারমোনিয়ামের গায়ে শিল্পী মো. বাবুল হোসেনের নিজের নাম, বাবা আফাজ খান ও মা মোছা. হাজেরা বেগমের নাম লেখা আছে। কথায় কথায় জানালেন, নওগাঁ সদরের ভীমপুর সিকদারপাড়ায় তাঁর বাড়ি। চার মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে তাঁর সংসার। তাঁর ওস্তাদ সাইদুল ইসলাম এখন অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। তিনি দেশের উত্তর অঞ্চলের কিচ্ছা–কাহিনির যুবরাজ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রাতের পর রাত বিয়ের গীত ও কিচ্ছা-কাহিনি গেয়ে তিনি মঞ্চ মাতিয়েছেন।
বাবুল হোসেন জানান, দীর্ঘদিন থেকে তাঁর ওস্তাদ অসুস্থ। এখন মঞ্চেও আর কাজ নেই। তাই এখন পথে পথে গান গেয়ে বেড়ান তিনি। কেউ খুশি হয়ে ২–১০ টাকা দিলে তাই দিয়ে খেয়ে না–খেয়ে কোনোরকমে সংসার চলে। সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। পথে এক জায়গায় গান গেয়ে ১০৫ টাকা পেয়েছেন। এরপর রাজশাহী কোট স্টেশন হয়ে গোদাগাড়ী যাবেন। কোনো নির্ধারিত অনুষ্ঠান নেই। যেখানে লোকজন বেশি থাকে, সেখানে গিয়ে তিনি গান শুরু করেন। যে যা দেন, তা নিয়েই খুশি থাকেন।
গলা থেকে হারমোনিয়াম নামাতে নামাতে বাবুল হোসেন বলেন, হারমোনিয়ামের ওপরের কভারটা ছিঁড়ে গেছে। বারবার আঠা দিয়ে জোড়া দিই, থাকে না। পেছন ফিরে যখন একটি রিকশা ধরার জন্য ঘুরে দাঁড়ালেন, দেখা গেল তাঁর কুর্তির পেছনের অংশও ছিঁড়ে গেছে। অর্থের অভাবে সেটিও হয়তো পাল্টাতে পারেননি। তবে তাঁর সুরেলা গলার কারণে গান জুড়ে দিলেই পথচারী থেমে যান। তিনি যাওয়ার পর এক নারী বলে উঠলেন, সবই পেটের জন্য!