চট্টগ্রামে টিসিবির পণ্য কেনার সারিতে দাঁড়াচ্ছেন কারা
ট্রাকের পেছনে লম্বা সারিতে মানুষের ভিড়। শুরুর দিকে থাকা নারী-পুরুষেরা টাকা দিয়ে চাল, ডাল ও ভোজ্যতেল বুঝে নিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে এক নারীর হাতে টাকা ও ব্যাগ দিয়ে শিশুসন্তানকে কোলে নিলেন মোহাম্মদ সবুজ। প্রায় আধা ঘণ্টার মতো ট্রাকের পাশে শিশু কোলে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। এ সময় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মোহাম্মদ সবুজ জানালেন পণ্য কেনার সারিতে দাঁড়ানো নারী তাঁর স্ত্রী।
দুই মেয়ের মধ্যে দুই বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে তাঁরা টিসিবির ট্রাক থেকে চাল, ডাল ও ভোজ্যতেল কিনতে এসেছেন। স্ত্রী-সন্তানের নাম জানাতে চাইলেন না সবুজ। বললেন, একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন তিনি। সম্প্রতি চাকরি ছেড়েছেন। সঞ্চয় দিয়ে এক মাসের মতো চলতে পারবেন। তাই টিসিবির ট্রাকই ভরসা।
গত সপ্তাহে দেওয়ানহাট এলাকায় টিসিবির পণ্য কেনার সারিতে দেখা হয় মোহাম্মদ সবুজের সঙ্গে। সেখানে কথা হয় রেহানা বেগম, নিলুফা আক্তারসহ আরও অন্তত ১০ জনের সঙ্গে। এই ১০ জনের প্রায় সবাই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মাসিক খরচে টান পড়েছে তাঁদের। তাই খরচ বাঁচানোর জন্য ভরসা সরকারি পণ্য বিক্রির ট্রাক। নগরের ১০টি পয়েন্টে কৃষি ওএমএস ও ২০টি পয়েন্টে টিসিবির পণ্য বিক্রির ট্রাকে প্রতিদিনই এমন ভিড় বাড়ছে। এসব সারিতে নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি হলেও এখন মধ্যম আয়ের মানুষও দাঁড়াচ্ছেন পণ্য কিনতে।
টিসিবির পণ্য কেনার সারিতে আগে এক সময় কেবল স্বল্প আয়ের মানুষের দেখা মিলত। এখন আগের পরিস্থিতি নেই। নগরের বিভিন্ন ট্রাক সেল পয়েন্টে গিয়ে অটোরিকশাচালক থেকে শুরু করে গৃহিণী, ক্ষুদ্র দোকানি, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্কুলশিক্ষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দেখা মিলছে।
চট্টগ্রামে বর্তমানে চারটি সরকারি সংস্থা দোকানে ও ট্রাকে পণ্য বিক্রি করছে। এর মধ্যে নগরের ২০টি স্থানে ট্রাকে করে ৭ হাজার ভোক্তার কাছে চাল, ডাল ও তেল বিক্রি করছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এই দুই সংস্থা ছাড়াও বর্তমানে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নগরের ১০টি স্থানে আলু, পেঁয়াজ, ডিমসহ ছয়টি কৃষিপণ্য বিক্রি করছে ভর্তুকি মূল্যে।
টিসিবির নিয়মিত কার্যক্রম হিসেবে প্রতি মাসে ‘পরিবার কার্ডের’ মাধ্যমে চট্টগ্রামের ৫ লাখ ৩৫ হাজার ভোক্তার কাছে এসব পণ্য বিক্রি করা হয়। টিসিবির পাশাপাশি খাদ্য অধিদপ্তরের ২৫টি দোকানে প্রতিদিন ২৫ টন চাল ও সাড়ে ৩৭ টন আটা বিক্রি হচ্ছে। পরিবার কার্ড বাড়াতেও টিসিবিকে জানিয়েছেন কয়েকজন ভোক্তা।
সারিতে দাঁড়াচ্ছেন যাঁরা
চট্টগ্রামে প্রায় ১৫ দিনের বেশি সময় ধরে টিসিবির ট্রাক সেল কার্যক্রম চলছে। এতে প্রতিদিন (শুক্রবার ছাড়া) সাত হাজার মানুষ চাল, ডাল ও ভোজ্যতেল কিনতে পারছেন। প্রায় একই সময় ধরে চলছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কৃষি ওএমএস। যেখানে প্রতিদিন ২ হাজার ৫০০ মানুষ ডিম, আলু, পেঁয়াজ ও সবজি কিনতে পারছেন।
বিভিন্ন সময় নগরের টিসিবির ট্রাক সেল ও কৃষি ওএমএসের সারিতে থাকা ১০০ জনের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ দেখা যায়, সারিতে থাকা অধিকাংশের আয় মাসে ২০ হাজারের নিচে। অনেকের আয় মাসে ১৫ হাজারের নিচে। তবে ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা আয় করেন, এমন মানুষকেও সারিতে পাওয়া গেছে। এ হিসাব তাঁদের দেওয়া পেশার তথ্য অনুযায়ী।
কথা হওয়া ১০০ জনের মধ্যে ৯ জন দিনমজুর, ১৫ জন গৃহকর্মী, ৮ জন অটোরিকশাচালক, ৭ জন রিকশাচালক, ২১ জন পোশাক ও কারখানার শ্রমিক, ৬ জন রেস্তোরাঁ ও দোকান কর্মচারী, ৬ জন বেসরকারি চাকরিজীবী, ১৪ জন ক্ষুদ্র দোকানি, ৬ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ৫ জন শিক্ষক ও ৩ জন ব্যাচেলর শিক্ষার্থী।
সারিতে থাকা ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের প্রত্যেকেরই আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মিলছে না। আয়ের তুলনায় অন্তত পাঁচ হাজারের ঘাটতি থাকে গড়ে। অধিকাংশই ঋণ করতে ও সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন। যাঁদের আয় ১৫ থেকে ২৫ হাজারের মধ্যে, তাঁরা যেমন দুশ্চিন্তায় আছেন, তেমনি যাঁদের আয় ৩০ থেকে ৪০ হাজারের ঘরে তাঁদেরও একই দুশ্চিন্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা বলেন, মহামারির পর থেকে অর্থনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীল। তখন সঞ্চয় ভেঙে সংসার সামলেছেন। এর পর থেকে সংসারের খরচ মেটাতে প্রতি মাসেই ঘাটতি থাকছে। ঋণের বোঝা বেড়েছে। বাসাভাড়া বেড়েছে, বিভিন্ন সেবা সংস্থার বিল ও বিভিন্ন খাতে ব্যয় বেড়েছে। সব মিটিয়ে বাজার খরচ রাখতে হয়, সেখানেও খরচ বেশি।
যে কারণে বাড়ছে মানুষ
চট্টগ্রামের বাজারে দুই মাস ধরে সবজির দাম কিছুটা বাড়তি। তবে শীতকালীন সবজি আসায় দাম কমতে শুরু করেছে গত সপ্তাহ থেকে। পেঁয়াজ ও আলুর দাম বাড়তির দিকে। অন্যদিকে সবজির দাম কমলেও তা এখনো খুচরা বাজারে প্রভাব ফেলেনি। ফলে সরকারি পণ্য কেনার ট্রাকের দিকে মানুষের বাড়তি ঝোঁক। বাজার থেকে অন্তত ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা সাশ্রয় হয় টিসিবি ও ওএমএসের প্যাকেজে।
কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ট্রাকে পণ্য বিক্রির যে বরাদ্দ, তার চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি। প্রতিদিন চাহিদা বাড়ছে। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও মানুষ পণ্য নিচ্ছেন। মূলত বাজার থেকে কম টাকায় পণ্য কেনা যাচ্ছে, কিছু টাকা সাশ্রয় হচ্ছে, তাই মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। একই কথা জানিয়েছেন টিসিবির পণ্য পরিবেশকেরা (ডিলার) ও সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড সচিবেরা।
বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে সরকারি ট্রাকের সামনে মানুষের সারি বাড়ছে বলে মনে করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম না কমলে এ সারি আরও দীর্ঘ হবে। মানুষের চাহিদার অনুপাতে আয় বাড়েনি। ফলে যেখানে সাশ্রয় হচ্ছে, সেদিকেই ছুটছে মানুষ।