‘এক সপ্তাহ ধইরা কামকাজ নাই, ধারকর্জ কইরা চলতাছি’
আজ বুধবার বেলা ১১টা। সিলেট নগরের মদিনা মার্কেট এলাকায় সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের ডান পাশে বসে বসে ঝিমুচ্ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব আবদুল বাতেন। কাছে যেতেই তাঁর ঝিমুনি ভাঙে। কিছুক্ষণ আলাপের পর তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলন ও কারফিউ ঘিরে চলমান পরিস্থিতিতে নিজের দুর্দশার কথা জানান। বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধইরা কামকাজ নাই। বেকার আছি। ঘরে খাওন নাই। ধারকর্জ কইরা চলতাছি।’
কেবল আবদুল বাতেন নন, তাঁর মতো সিলেটের সব স্বল্প আয়ের মানুষ চলমান পরিস্থিতিতে পড়েছেন বিপাকে। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার কোটা আন্দোলনকারীদের দেওয়া কর্মসূচি কমপ্লিট শাটডাউন (সর্বাত্মক অবরোধ), এরপর শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে চলছে কারফিউ। সাত দিন ধরে আয়রোজগার বন্ধ থাকায় দিনমজুর, হকার, ফলদোকানি, মুচি, ফেরিওয়ালা, রিকশাচালকসহ নানা পেশার মানুষ ছেলেমেয়ে নিয়ে আহাজারি করছেন।
আজ বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মদিনা মার্কেটের শ্রমের হাটে অবস্থান করে কথা হয় ছয়জন দিনমজুরের সঙ্গে। তাঁরা সবাই জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার সময় প্রায় সবাই অবরুদ্ধ ছিলেন। দুই দিন ধরে সবকিছু ফের স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তবে দিনমজুরদের এখনো কেউ কাজে সেভাবে নিচ্ছেন না। এতে তাঁরা বিপাকে পড়েছেন। আর্থিক সংকটে পড়ে অনেকে ধারকর্জ করে কোনো রকমে জীবন যাপন করছেন।
পনিটুলা এলাকার বাসিন্দা দিনমজুর কল্যাণ দাস বলেন, স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার। এ ছাড়া বয়স্ক মা-ও আছেন। দিনমজুর হওয়ায় যেদিন কাজ পান, সেদিন বাজারসদাই করেন। অথচ এখন এক সপ্তাহ ধরে কর্মহীন। এ অবস্থায় দোকান থেকে বাকিতে চাল, ডাল, আলু কিনেছেন। সামান্য কিছু টাকা ধার করে গত রোববার কিছু ছোট মাছ কিনেছিলেন। এখনো কাজ পাচ্ছেন না। বিপাকে আছেন।
রাজমিস্ত্রি মকবুল মিয়ার (৪৬) বাসা হাওলাদারপাড়া এলাকায়। তিনি বলেন, কারফিউর কারণে কয়েক দিন ধরে নির্মাণকাজ বন্ধ। এতে তিনি বেকার হয়ে পড়েছেন। জমানো টাকা ফুরিয়ে যাওয়ায় গত সোমবার ২৫ হাজার টাকা ধার করেছেন। কবে কাজ শুরু করতে পারবেন, তা-ও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। আবার কাজ শুরু হলেও ধারের টাকা শোধ করবেন কীভাবে, সে দুশ্চিন্তা ভর করেছে।
বেলা দুইটা পর্যন্ত নগরের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার আরও ১৮ জন মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। সবারই অভিন্ন ভাষ্য, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। বিশেষ করে রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক, হকার, মুচি, দিনমজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বেশি বিপাকে আছেন। জীবনযাত্রা ও ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ার প্রভাব তাঁদের মধ্যেই বেশি পড়েছে। টাকার অভাবে অনেকে খেয়ে-না খেয়ে কোনো রকমে আছেন।
বেলা দেড়টার দিকে জেলরোড এলাকায় কথা হয় রিকশাচালক মাসুক মিয়ার (৩৫) সঙ্গে। তাঁর গ্যারেজ বালুচর এলাকায়। মাসুক বলেন, প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে তাঁর দৈনিক আয় নয় শ থেকে এক হাজার টাকা। রিকশামালিকের ভাড়া, খাওয়াসহ সব খরচ বাদে তাঁর ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা থাকত। কিন্তু গত এক সপ্তাহে তাঁর আয়ে ভাটা পড়েছে। কারফিউর ফাঁকে ফাঁকে রিকশা নিয়ে বের হলেও তিনি এ দিনগুলোতে ২০০ থেকে ২৫০ টাকার বেশি আয় করতে পারেননি। কারণ, ওই সময় মানুষ খুব একটা বের হয়নি। এখন মানুষের চলাচল কিছুটা বাড়লেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। তাই সীমিত উপার্জনে তিনি কষ্টে আছেন।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষেরা সবচেয়ে সমস্যায় আছেন। যাঁরা দিনমজুর, তাঁরা দৈনিক আয়ের ওপরই নির্ভর করে সংসার চালান। এসব মানুষ কর্মহীন হয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন। তাঁদের সহায়তায় সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান মানুষদের এগিয়ে আসা উচিত।