ঘূর্ণিঝড় মিধিলি
বিধ্বস্ত স্কুলঘর পড়ে আছে পাশের পুকুরে, খোলা আকাশের নিচে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা
বিদ্যালয়ের খোলা আঙিনায় রোদের মধ্যে বসানো হয়েছে টুল-বেঞ্চ। সারি সারি বেঞ্চে বসে একমনে লিখছে শিক্ষার্থীরা। পাশে দাঁড়িয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা তদারক করছেন। হালকা বাতাসেও খাতাপত্রের পৃষ্ঠা উল্টে যাচ্ছিল। এক হাতে তা চাপা দিয়ে লিখতে হচ্ছিল শিক্ষার্থীদের। পাশেই পুকুরে পড়ে আছে ঝড়ে বিধ্বস্ত স্কুলঘরের টিন আর বাঁশের কাঠামো।
আজ বুধবার সকালে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পশ্চিম চর জুবলি আব্দুল মালেক উকিল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেল। গত শুক্রবার ঘূর্ণিঝড় মিধিলির আঘাতে বিদ্যালয়টির টিনের চালসহ পুরো কাঠামোই বিধ্বস্ত হয়ে গিয়ে পড়ে পাশের পুকুরে। আজ থেকে শুরু হয়েছে বার্ষিক মূল্যায়ন পরীক্ষা। বিদ্যালয়টির ২০০ শিক্ষার্থী খোলা আকাশের নিচে রোদের মধ্যে বসে পরীক্ষায় অংশ নেয়।
পরীক্ষার মাঝেই শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিদ্যালয়ের এমন করুণ হাল নিয়ে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বললেন। অক্ষত টুল-বেঞ্চ যা আছে, তাতেও সবার সংকুলান হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে বসেই পরীক্ষা দিতে হচ্ছে।
পরীক্ষা দিয়ে ঘেমেনেয়ে একাকার সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সালমা আক্তার। ঘাম মুছতে মুছতে সে বলে, ‘খোলা আকাশের নিচে রোদের মধ্যে বসে পরীক্ষা দিতে খুবই কষ্ট হয়েছে। বাতাসের কারণে ঠিকমতো লিখতেও পারছিলাম না। বেঞ্চগুলো ভেঙে যাওয়ায় বসতে অনেক কষ্ট হয়েছে।’
বিদ্যালয়ের মাটির ভিটাটাই এখন অস্থায়ী শ্রেণিকক্ষ। অল্প কিছু কাঠের বেঞ্চ সারিবদ্ধ করে রাখা সেখানে। এক পাশে ভাঙাচোরা বেঞ্চ ও টেবিল নিয়ে বসেছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। জায়গাটি শিক্ষক মিলনায়তনের মতো হয়ে উঠেছে। ঝড়ে তাণ্ডবের পরও এই আবহ শিক্ষার্থীদের মনে সাহস এনে দিচ্ছে। গত চার দিনে অনেকেই বিদ্যালয়ে আসেনি।
আজ উপস্থিতি বেড়েছে। পরীক্ষায়ও অংশ নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। মনোবল সম্বল করেই বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছেন বলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানালেন।
বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রূপা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বিদ্যালয়ের টিনশেড ঘর বিধ্বস্ত হওয়ায় তাঁদের পক্ষে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। চার দিন ধরেই এমন পরিবেশে ক্লাস নিচ্ছেন তাঁরা। ভাঙাচোরা চেয়ার–টেবিল বসিয়ে কোনোরকমে পাঠদান অব্যাহত রেখেছেন। শিক্ষার্থীদের বসার মতোও চেয়ার টেবিল নেই।
বিদ্যালয়টির পাশে থাকেন শামসুল হক সওদাগর নামের এক ব্যক্তি। সেদিন ঝড়ে স্কুলঘরটি উড়ে যেতে দেখেছেন তিনি। জানতে চাইলে শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যখন ঘূর্ণিঝড়ে স্কুলঘরটি বিধ্বস্ত হচ্ছিল, তখন তিনি পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ ঝোড়ো বাতাস এসে প্রথমে স্কুলঘরটিকে ওপরের দিকে কয়েক ফুট ওঠায়। এরপর দ্বিতীয় দফায় বাতাস ঘরটি ছিন্নভিন্ন করে পাশের পুকুরে ফেলে দেয়।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চিম চর জুবলি এলাকায় কোনো বিদ্যালয় ছিল না। ২০০৯ সালে স্থানীয় শিক্ষানুরাগী বাহাউদ্দিনের উদ্যোগে সাবেক স্পিকার আব্দুল মালেক উকিলের নামে ‘পশ্চিম চর জুবলি আব্দুল মালেক উকিল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। নতুন শিক্ষানীতির আলোকে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এই বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়।
মো. পারভেজ আরও বলেন, শুক্রবারের ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বিদ্যালয়ের একমাত্র টিনশেড ঘরটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। এতে বিদ্যালয়ে পড়ুয়া দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে বার্ষিক মূল্যায়ন পরীক্ষার সময় চলে আসায় আজ থেকে তারা খোলা আকাশের নিচে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যালয়টি মেরামতে সরকারি সহায়তার আবেদন জানান তিনি।