‘কী দোষে আমার এমন সুন্দর ভাইকে গুলি করে মারল’

রিফাত হোসেনছবি: সংগৃহীত

‘বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও কাজে না গিয়ে দেশ স্বাধীন করার জন্য আন্দোলনে গেল, আর ফিরল লাশ হয়ে। আমার ভাইরে (রিফাত হোসেন) কেন মেরে ফেলল, কারা এবং কেন আমার ভাইরে গুলি করল? সে তো কোনো রাজনীতি করত না, কখনো কারও বিরুদ্ধে কথা বলত না। খুবই নিরীহ স্বভাবের সাদা মনের মানুষ ছিল। এখন আমার ভাইয়ের কষ্ট ভুলি কীভাবে? তাকে ছাড়া আমি বাঁচব কীভাবে?’

বিলাপ করতে করতে সোমবার সকালে এ কথা বলছিলেন রিফাত হোসেনের (২২) একমাত্র বোন হালিমা আক্তার। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের এক দফা দাবিতে গত ৪ আগস্ট কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার শহীদ নগরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গুলিতে নিহত হন রিফাত।

রিফাতের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার সুখীপুর গ্রামে। সোমবার সকালে সুখীপুর গ্রামের কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায়, এক আত্মীয় রিফাতের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করছেন।

পরে উপজেলার দশপাড়া গ্রামে রিফাতের বোনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট দোচালা টিনের জীর্ণশীর্ণ ঘরের আশপাশে কেমন যেন নীরবতা ও শোকের আবহ নেমে এসেছে। আশপাশে কেউ নেই। রিফাতের ভগ্নিপতি সাইদুল ইসলাম পাঠানের ঘরে ঢুকতেই হালিমা আক্তার হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। পাশেই বসা ছিলেন সাইদুলের মা নিলুফা বেগম। তিনিও কান্নায় ভেঙে পড়লেন। দুজনের কান্নার শব্দে মুহূর্তেই বাতাস ভারী হয়ে উঠল। একমাত্র ভাইকে হারিয়ে হালিমার আহাজারি যেন থামছেই না।

এখানে সমাহিত করা হয়েছে রিফাতকে। সোমবার সকালে তোলা দাউদকান্দি উপজেলার সুখীপুর গ্রামে
ছবি: আবদুর রহমান ঢালী

রিফাতের জন্মের পরপরই বাসচালক বাবাকে হারান এ দুই ভাই-বোন। এরপর খুব কাছ থেকে জীবনের উত্থান-পতন দেখতে দেখতে নানাবাড়িতে বড় হন তাঁরা। একপর্যায়ে তাঁদের রেখে অন্যত্র দ্বিতীয় বিয়ে করে সেখান থেকে চলে যান মা রিফা আক্তার। এত সংকটের মধ্যে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন রিফাত। তবে আর্থিক সংকটের কারণে সেটিও বন্ধ করে মুন্সিগঞ্জে কাজ শুরু করেন। গত জুলাই মাস পর্যন্ত সেখানে বেকারিতে কাজ করতেন। পরে কাজটি ছেড়ে বোন হালিমার বাড়িতে থেকে ভগ্নিপতি সাইদুলের কাছে পাইপ সংযোগের কাজ শিখতেন।

হালিমার ভাষ্য, গত ৪ আগস্ট সকালে রিফাত কাজে না গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় তাঁকে আন্দোলনে যেতে একাধিকবার নিষেধ করা হয়। রিফাতকে বলেছিলেন, ‘তোর কিছু হলে আমি কী করে বাঁচব?’ জবাবে রিফাত হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘আমার কিছুই হবে না ইনশা আল্লাহ, দেশ স্বাধীন করে আবার ঘরে ফিরব।’ ওই দিন দুপুরেই খবর আসে রিফাত গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুলিতে নিহত রিফাত হোসেনের পাঞ্জাবি দেখাচ্ছেন বড় বোন হালিমা আক্তার। সোমবার সকালে দাউদকান্দি উপজেলার সুখীপুর গ্রামে
ছবি: আবদুর রহমান ঢালী

হালিমার দাবি, ওই অবস্থায় রিফাতকে উদ্ধার করে প্রথমে দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এরপর তাঁকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। পরে তাঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। সেখানে বিনা চিকিৎসায় ৪ আগস্ট রাতে নিজ বাড়িতে রিফাতের মৃত্যু হয়। পরদিন (৫ আগস্ট) সকাল ১০টায় উপজেলার দশপাড়া ঈদগাহ মাঠে জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

রিফাতের হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন হালিমা। ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, ‘কী দোষে আমার এমন সুন্দর ভাইকে এভাবে গুলি করে মারল? আমার একমাত্র ভাইকে গুলি করতে তাদের বুক কি একটুও কাঁপেনি? তারা কি মানুষ না? দেশ স্বাধীনতা পেল, অথচ আমার ভাই সেই স্বাধীনতা দেখে যেতে পারল না; আমার ভাই হত্যার বিচার চাই, প্রকৃত খুনিদের ফাঁসি চাই।’

কী দোষে আমার এমন সুন্দর ভাইকে এভাবে গুলি করে মারল? আমার একমাত্র ভাইকে গুলি করতে তাদের বুক কি একটুও কাঁপেনি? তারা কি মানুষ না? দেশ স্বাধীনতা পেল, অথচ আমার ভাই সেই স্বাধীনতা দেখে যেতে পারল না
রিফাতের বড় বোন হালিমা আক্তার

রিফাতের রেখে যাওয়া পোশাক, বালিশ-কম্বল, মুঠোফোন—এসব চিরদিন স্মৃতি হিসেবে রাখতে চান হালিমা। কথার একপর্যায়ে মুঠোফোনটি হাতে নিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। বলতে থাকেন, ‘ভাইয়ের মুঠোফোনটি হাতে নিলে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারি না। ছোট বেলায় দুই ভাই-বোনকে নানাবাড়িতে একা রেখে মা কাজে যেতেন। ভাই-বোন একসঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটাতাম, একসঙ্গে খেলাধুলা করতাম। এখন এসব কেবলই স্মৃতি।’