‘আমার নিরীহ ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে ওরা’

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে সরকারের নির্দেশে দেশের ভেতরে সব ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ ছিল। এ কারণে প্রথম আলো ডটকমে কোনো সংবাদ বা লেখা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। যদিও এ কয়েক দিনে নানা ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সংঘাত–সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৯৭ জন। সংকট নিরসনে সরকারও একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এ সময়ে ছাপা পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য উল্লেখযোগ্য সংবাদ ও লেখাগুলো অনলাইনে প্রকাশ করা হলো। এই প্রতিবেদনটি শনিবার (২০ জুলাই) প্রকাশিত হয়েছিল।

পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল থেকে বাঁচতে টায়ারে আগুন দেন আন্দোলনকারীরা। ১৮ জুলাই দুপুরে উত্তরায়ছবি: সংগৃহীত

‘আমার ছেলে অত্যন্ত বিনয়ী ও শান্ত ছিল। সে কোনো দিন আন্দোলনে যায়নি। আমার নিরীহ-নিরপরাধ ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে ওরা। সরকার কি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবে?’ কথাগুলো বলেছেন ঢাকার উত্তরায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া এক শিক্ষার্থীর মা। নিহত ওই শিক্ষার্থীর নাম জাহিদুজ্জামান তানভীন (২৫)। তিনি গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির যন্ত্র প্রকৌশল (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) বিভাগ থেকে দুই বছর আগে স্নাতক করেন। যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তরে পড়তে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার পর ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকায় পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন জাহিদুজ্জামান। তাঁর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের ভিটি-বিশাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা মো. শামসুজ্জামান ঢাকায় টোয়া করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। মা বিলকিস জামান গৃহিণী। একমাত্র বোন জেসিকা জামান আয়েশা যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তর করছেন। জাহিদুজ্জামান মা-বাবার সঙ্গে উত্তরার আজমপুর এলাকায় থাকতেন।

জাহিদুজ্জামানকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বৃহস্পতিবার দুপুরে উত্তরার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতেই দাফন করা হয়।

একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান মা-বাবা। ছেলেকে দাফনের পর গতকাল শুক্রবার নবীনগরের ভিটি-বিশাড়া গ্রামে ছিলেন তাঁরা। গতকাল বিকেলে যখন তাঁদের সঙ্গে কথা হয়, তখন মা বিলকিস জামান শুধু বিলাপ করছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমাকে আত্মঘাতী বোমা এনে দেন। আমি মরে ছেলের কাছে চলে যাব।’

বিলকিস জামান জানান, একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে জাহিদুজ্জামান বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে বাসা থেকে বের হন। দ্রুতই ফিরে আসবেন বলে তাঁকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু আধা ঘণ্টা পর এক শিক্ষার্থী ফোন করে জানান, তাঁর ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। পরে হাসপাতালে গিয়ে ছেলের লাশ দেখতে পান।

জাহিদুজ্জামানের স্নাতক শেষ হয়েছিল ২০২২ সালে। তিনি তিন বন্ধুকে নিয়ে ‘অ্যান্ট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তাঁরা ড্রোন দিয়ে জরিপের কাজ করতেন। পাশাপাশি অনলাইনে ড্রোন বিক্রি করতেন।

জাহিদুজ্জামান এই প্রতিষ্ঠানকে আরও বড় করতে চেয়েছিলেন জানিয়ে বাবা মো. শামসুজ্জামান বলেন, ছেলের স্বপ্ন ছিল যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তর করে আবার দেশে ফিরে আসবে। দেশের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ছিল।

ছেলের সঙ্গে বৃহস্পতিবার সকালে সর্বশেষ কথা হয় জানিয়ে শামসুজ্জামান বলেন, ফজরের নামাজ পড়তে ছেলেকে ডেকে তুলেছিলেন। সে উঠে নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে তিনি অফিসে চলে যান। দুপুরে ফোনে জানতে পারেন, তাঁর ছেলে মারা গেছেন।

শামসুজ্জামান বলেন, তখন ভেবেছিলেন জাহিদুজ্জামান সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। তবে হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন, বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁর ছেলের মৃত্যু হয়েছে। এই বাবা বলেন, ‘আমার ছেলে কোরআন-হাদিস খুব ভালো জানত। নিয়মিত নামাজ পড়ত। সেই ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে তারা।’