স্বামী–স্ত্রীসহ ৮ সদস্যের পরিবারে ৬ জনই প্রতিবন্ধী, কোনোমতে চলে সংসার
নিম্নমানের ইটের প্রাচীরের ওপর টিনের চালার ঘর। টিনগুলোতে মরচে ধরেছে, কোথাও ফুটো হয়ে গেছে। চার সন্তানকে নিয়ে সেই ঘরের বারান্দায় বসে আছেন আরিকুল্লাহ। কেউই সুস্থ নন, শারীরিক প্রতিবন্ধী। তাঁদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আরিকুল্লার স্ত্রী রেজিয়া বেগমেরও পায়ে সমস্যা থাকায় হাঁটতে পারেন না।
আরিকুল্লাহ–রেজিয়া দম্পতির বাড়ি রাজশাহীর বাগমারার গণিপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রামে। তাঁরাসহ পরিবারের মোট সদস্য আটজন। তাঁদের মধ্যে ছয়জনই শারীরিক প্রতিবন্ধী। যদিও কেউই প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। ১১-১২ বছর বয়সে এসে অসুস্থতা থেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তাঁরা। এখন বিনা চিকিৎসায় আর খাবারের সংকটে কোনোমতে দিনযাপন করছেন।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে মহব্বতপুর গ্রামে গিয়ে পরিবারটির দুর্দশা দেখা যায়। বারান্দায় বসে থালায় সামান্য কিছু ভাত নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত আরিকুল্লাহকে (৬৪)। পাশে থাকা প্রতিবন্ধী ময়েন (৪৫) বারবার বাবার থালার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তবে খাবার থালা একটাই। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘরের ভেতরে থাকা আরও তিনজনকে বারান্দায় আনা হয়। সবাই শারীরিক প্রতিবন্ধী। এই ছয়জনের মধ্যে কথা বলতে পারেন স্বামী-স্ত্রীসহ তিনজন। বাক্শক্তি নেই অপর তিনজনের।
আরিকুল্লাহ-রেজিয়া বেগম দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে রেজাউল হক (৪৩) ও রাজু আহমেদ (৩৪) সুস্থ রয়েছেন। তাঁদের উপার্জনে চলে সংসার। প্রতিবন্ধী মা–বাবা এবং ভাইবোনদের চালাতে গিয়ে নিজের সংসার গড়ার কথা যেন ভুলে গেছেন রেজাউল হক। তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের গল্প শোনান।
রেজাউল হক বলেন, দাদির কাছ থেকে শুনেছেন তাঁর বাবা (আরিকুল্লাহ) যুবক বয়সে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পায়ের সমস্যার কারণে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেন না। তাঁর মায়েরও ডান পায়ের সমস্যা। তিনি চলাফেরা করতে পারলেও স্বাভাবিক মানুষের মতো নয়। তাঁর বড় ভাই ময়েন উদ্দিন জন্মের ১৩ বছরের মধ্যেই প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। স্থানীয় মহব্বতপুর হাট থেকে বাজার করে বাড়িতে আসার পর দুই পা অকেজো হয়ে পড়ে। সঙ্গে দুই হাতও। আস্তে আস্তে হাত-পা সরু হয়ে যায়। সে থেকে তিনি শয্যাশায়ী। আরেক বোন রেবেকা খাতুন (৪০) শারীরিকভাবে অসুস্থ ও খর্বাকার। চলাফেরা করতে পারলেও মানসিক সমস্যা রয়েছে।
আরিকুল্লাহর আরেক ছেলে গাজলুর রহমান (৩৭) ও ছোট মেয়ে রেখা খাতুনও (১৫) অন্যদের মতো ১২-১৩ বছর বয়স পার হলেই শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। তাঁরাও চলাফেরা করতে পারেন না। শুয়ে–বসে সময় পার করতে হচ্ছে।
আরিকুল্লাহ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তিনি আক্রান্ত হওয়ার পর স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন। সন্তানদেরও চিকিৎসা করানো হয়েছে। তবে কী রোগ, তা বলতে পারেননি চিকিৎসকেরা।
রেজিয়া বেগম জানান, তাঁর এক পায়ের সমস্যা। তবে হালকা কাজ করার পাশাপাশি প্রতিবন্ধী স্বামী ও সন্তানদের দেখাশোনা করতে হয়। রান্না ও ঘরের কাজ করার পাশাপাশি সবাইকে খাওয়ানো, গোসল, প্রাকৃতিক কাজ করানো সবই তাঁকেই করতে হয়। পায়ের সমস্যা ও বয়স বাড়ার কারণে খুব সমস্যা হয়। তিনি নিজেদের দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। বলেন, তিন বেলা খাবার জোটে না। পরিবারের দুই সদস্যের প্রতিবন্ধী ভাতা ও স্বাভাবিক থাকা দুই ছেলের সামান্য উপার্জন দিয়ে সংসার চলে।
পরিবার চালাতে গিয়ে বিয়ে করতে পারেননি উল্লেখ করে মেজ ছেলে রেজাউল হক বলেন, বাজারে একটা চায়ের দোকান আছে, সেখান থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে এবং মাঝেমধ্যে দিনমজুরি খেটে প্রতিবন্ধী মা–বাবা এবং ভাইবোনদের দেখাশোনা করতে হয়। বিয়ে করলে নিজের সংসার চালাতে গিয়ে অসহায় পরিবারকে দেখাশোনা করা যাবে না।
গণিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান বলেন, পরিবার থেকে দুজনের ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে পরিবারটি অসহায় বলে মন্তব্য করেন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ আমজাদ হোসেন প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, এটা স্পিনোসেরেবেলার অ্যাটাক্সিয়া (জিনগত সমস্যা) হতে পারে। তাঁদের পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর প্রয়োজনে মেডিকেল বোর্ড করা যাবে। তবে রোগটি জটিল বলে মন্তব্য করেন।