সকালের নাশতা বলতে ছিল চালভাজা। তারপর মেশিনে সেলাইয়ের কাজ শুরু হতো। কাজ শেষে বিদ্যালয়ে যাত্রা। টিফিনের টাকা ছিল না। না খেয়ে ক্লাস করেছে রোকসেনা আক্তার। বিকেলে বাড়িতে ফিরে কোনো দিন খাবার জুটেছে, কোনো দিন জোটেনি। তারপর আবার সেলাইয়ের কাজে বসতে হয়েছে। রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করে তারপর গভীর রাত বা ভোর পর্যন্ত চলত পড়াশোনা।
এত কষ্টের পরও রোকসেনা আক্তার দমে যায়নি। কমেনি তার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ। রোকসেনার মতো সাদিয়া সুলতানা, তানজিদা আক্তার ও শাম্মি আক্তারও শত প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সাদিয়া, শাম্মি, রোকসেনা এবার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। আর তানজিদা আক্তার মানবিক বিভাগ থেকে থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
সেলাইয়ের ফাঁকে পড়ত রোকসেনা
রোকসেনা আক্তার গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর বহুমুখী পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। তার বাড়ি উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের বড়জামালপুর গ্রামে। বাবা এখলাছ সরকার অটোরিকশাচালক। মা আরেফা বেগম গৃহিণী। পাঁচ শতক বসতভিটা ছাড়া তাঁদের কোনো সহায়–সম্পদ নেই। বসতভিটায় একটি টিনের ঘর। দুই বোনের মধ্যে রোকসেনা বড়। ছোট বোন রিওনা আক্তার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
সাদুল্যাপুর বহুমুখী পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রেহেনা বেগম বলেন, রোকসেনা দরিদ্র হলেও সে খুব মেধাবী। পড়ালেখায় তার যথেষ্ট আগ্রহ। তাই তাকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
রোকসেনা জানায়, সেলাই করে সে পড়াশোনার খরচ মিটিয়েছে। সেলাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে সময় বের করে চলত পড়াশোনা। পড়াশোনায় সহায়তা পেলে ভবিষ্যতে সে চিকিৎসক হতে চায়।
এখলাছ সরকার জানান, অটোরিকশা চালিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। তার ওপর দুই মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। মেয়ে এখন কলেজে ভর্তি হবে, খরচও বেশি হবে। এ নিয়ে চিন্তায় আছেন তিনি।
প্রাইভেট পড়ার সুযোগ ছিল না সাদিয়ার
সাদিয়া সুলতানার বাড়ি রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুর ইউনিয়নের চরখানখানাপুর গ্রামের দত্তপাড়া এলাকায়। প্রতিদিন তিন কিলোমিটার হেঁটে রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে যেত সে।
সাদিয়া জানায়, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় দাদার মৃত্যু হওয়ার পর থেকে তার চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু তার লেখাপড়ার খরচ চালানোর মতো সামর্থ্য তার বাবার নেই। টাকার অভাবে সে প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পায়নি। নিজে নিজেই পড়েছে।
সাদিয়ার মা সাগরিকা বেগম বলেন, ‘আমার তিনটি সন্তান পড়ালেখা করে। ওদের বাবা রিকশা চালায়। অল্প একটু জমি লিজ (ইজারা) নিয়ে চাষাবাদ করি আর বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করি। এসব দিয়ে কোনোমতে সংসার চালাই। কষ্ট করে পড়ে সাদিয়া পরীক্ষায় ভালো করেছে। এখন ওর পড়ালেখা নিয়েই দুশ্চিন্তা।’
শিক্ষক হতে চায় শাম্মি
বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার ইউনিয়নের সান্দিড়া গ্রামের সাইদুল ইসলামের মেয়ে শাম্মি আক্তার। শাম্মির বাবা সাইদুল মুদিদোকানি আর মা মিরা বেগম গৃহিণী। শাম্মি সান্দিড়া শহীদ সিরাজ খান মেমোরিয়াল একাডেমিতে পড়াশোনা করত।
শাম্মি বলে, তার পড়াশোনার প্রধান প্রেরণা ছিল মা ও বাবা। তাঁদের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাকে সাহস জুগিয়েছেন। অভাবের সংসারে অনেক কষ্ট করে মা–বাবা তার পড়াশোনার খরচ বহন করেছেন। নিজেরা কষ্ট করেছেন, কিন্তু তার (শাম্মির) পড়াশোনা ব্যাহত হতে দেননি। নিয়মিত প্রাইভেট বা কোচিং করার মতো সামর্থ্য না থাকায় বেশির ভাগ সময় সে বাড়িতেই মন দিয়ে লেখাপড়া করত। ভবিষ্যতে শাম্মি শিক্ষক হতে চায়।
শিক্ষক হতে চায় তানজিদা
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার তানজিদা আক্তার ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের সুবর্ণগাঁতী উচ্চবিদ্যালয় থেকে পাস করেছে। সে নওদা ব্রহ্মগাছা গ্রামের মো. এনামুল হক ও চায়না বেগমের দ্বিতীয় সন্তান।
তানজিদা বলে, অভাবের সংসারে ছোটবেলায় নানাবাড়ির স্কুলে পড়ালেখা শুরু করে সে। তার বাবা ঢাকায় রিকশা চালাতেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবার কাছে ঢাকায় চলে যায় সে। সেখানে আবার বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কিন্তু নানা সমস্যার কারণে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আবার গ্রামে চলে আসতে হয় তাকে। কলেজে ভর্তির জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ৩ হাজার ১০০ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু বাকি খরচ কীভাবে চালাবে? সম্বল বলতে রয়েছে বাড়ির চার শতক জায়গা।
চায়না বেগম বলেন, ‘অভাবের সংসারে ঠিকমতো কোনো কিছুই ছেলে–মেয়েদের দিতে পারি নাই। যদি কেউ সাহায্য করত, তবে মেয়েটার পড়ালেখার জন্য আর চিন্তা করতে হতো না।’
তানজিদা বলে, যত কষ্টই হোক না কেন, পড়ালেখা শেষ করে মা–বাবার দুঃখ দূর করার চেষ্টা করবে। পেশা হিসেবে শিক্ষকতা তার পছন্দ।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন শাহাবুল শাহীন, গাইবান্ধা; এজাজ আহম্মেদ, রাজবাড়ী; সাজেদুল আলম, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও খায়রুল ইসলাম, আদমদীঘি, বগুড়া]