প্লাস্টিক বর্জ্য মুক্ত হচ্ছে সেন্ট মার্টিন

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় সৈকতে শোভাযাত্রা বের করা হয়। আজ সকালে কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপেপ্রথম আলো

প্লাস্টিক বর্জ্য মুক্ত হচ্ছে কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। এখন থেকে দ্বীপের দূষণকারী প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের পর রিসাইকেল (পুনর্ব্যবহার) করা হবে। এমন উদ্যোগ সফল হলে দ্বীপের পরিবেশদূষণ যেমন কমে আসবে, তেমনি প্রবালসহ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।

আট বর্গকিলোমিটারের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সুরক্ষায় এ প্রকল্প যৌথভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ প্রাণ-আরএফএল ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। আজ সোমবার বেলা ১১টায় ‘সেন্ট মার্টিন: পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই অর্থনীতি’ শীর্ষক এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার।

কর্মসূচির আওতায় প্রতিবেশ সংকটাপন্ন দ্বীপটির পরিবেশদূষণকারী বর্জ্য সংগ্রহ ও সংগৃহীত বর্জ্য রিসাইকেল করা হবে। এ ছাড়া দ্বীপের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনে সহায়তা করা হবে। পাশাপাশি দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা, পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে নানা ধরনের কর্মসূচি এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দ্বীপে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

আজ সকালে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ও আমার সেন্ট মার্টিন নামের একটি সংগঠনের সহযোগিতায় পর্যটকসহ দ্বীপের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার পাঁচ শতাধিক মানুষ সৈকত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশ নেন।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পূর্ব পাশের জাহাজঘাট থেকে শুরু করে দ্বীপের পশ্চিম সৈকত পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটারে পড়ে থাকা আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়। এ সময় সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সৈকত ও বাজার এলাকায় শোভাযাত্রা বের করা হয়। বিলি করা হয় প্রচারপত্র।

কর্মসূচিতে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের হেড অব করপোরেট ব্র্যান্ড নুরুল আফসার, হেড অব সাসটেইনেবিলিটি সুমাইয়া তাবাসসুম আহমেদ, ইউএনডিপির ডেটা অ্যানালাইটিকস কর্মকর্তা আহমেদ উল্লাহ কবির এবং আমার সেন্ট মার্টিনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

দ্বীপের প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের পর যন্ত্রের মাধ্যমে সংকুচিত করে রিসাইক্লিং প্ল্যান্টে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ সকালে কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে
প্রথম আলো

বেলা ১১টায় ‘সেন্ট মার্টিন পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই অর্থনীতি’ শীর্ষক প্রকল্পের উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার। তিনি বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকদের যাতায়াত, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, পরিবেশদূষণ, পর্যটকদের অসচেতনতার কারণে এখানকার প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্বীপটিকে রক্ষায় নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রাণ-আরএফএল ও ইউএনডিপির যৌথ উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সবার সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমেই কেবল সেন্ট মার্টিনকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, সামুদ্রিক ‘ব্লু ইকোনমি’ রক্ষা, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই অর্থনীতি নিশ্চিতে সহায়তা করতে ইউএনডিপির সঙ্গে প্রাণ-আরএফএল এ উদ্যোগ নিয়েছে। এ কর্মসূচির অধীনে প্রাণ–আরএফএলের স্বেচ্ছাসেবকেরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে দ্বীপের নির্ধারিত ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে আসবে। বর্জ্যগুলো যন্ত্রের মাধ্যমে সংকুচিত করে সমুদ্রপথে টেকনাফে আনা হবে। এরপর নিজস্ব পরিবহনের মাধ্যমে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও ডাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের রিসাইক্লিং প্ল্যান্টে রিসাইকেল করা হবে।

দ্বীপের জেলেদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা দিতে তাদের সংগৃহীত সামুদ্রিক মাছ ও শুঁটকি সংগ্রহ করে সেগুলা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের রিটেইল চেইন শপে ‘সেন্ট মার্টিন এক্সক্লুসিভ’ নামে একটি কর্নারে বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে জানিয়ে কামরুজ্জামান কামাল বলেন, এ ছাড়া বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মাধ্যমে দ্বীপবাসীদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

ইউএনডিপির হেড অব এক্সপেরিমেন্টেশন রমিজ উদ্দিন বলেন, টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতে ইউএনডিপি সব সময় কাজ করে যাচ্ছে। ইউএনডিপি প্রথমে দ্বীপে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করত, এরপর প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ যুক্ত হওয়ায় এ কাজের গতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, সেন্ট মার্টিনসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সৈকত থেকে বর্জ্য সংগ্রহে নেমেছেন পর্যটক, স্বেচ্ছাসেবক ও দ্বীপের বাসিন্দারা। আজ সকালে তেলা
প্রথম আলো

সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সর্বশেষ ২০২০ সালের আগস্টে সেখানে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সরকারের তরফে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসকে (সিইজিআইএস) একটি সমীক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা শেষে জানায়, দ্বীপটিতে কোনোভাবেই পর্যটকদের রাতে থাকার অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না। শীতে পর্যটন মৌসুমে দিনে ১ হাজার ২৫০ জনের বেশি পর্যটক যেতে দেওয়া ঠিক হবে না।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারি সেন্ট মার্টিনের সুরক্ষায় নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নভেম্বর মাসে পর্যটকেরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে যেতে পারবেন, তবে রাত যাপন না করে দিনেই ফিরে আসতে হবে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি—এই দুই মাস পর্যটকেরা সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ ও সেখানে রাত যাপনের সুযোগ পাচ্ছেন। তবে পর্যটকের সংখ্যা দৈনিক দুই হাজার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের যাতায়াত বন্ধ থাকবে। গত ১ নভেম্বর থেকে কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়। গতকাল তিনটি জাহাজে দেড় হাজারের মতো পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে আসেন। এর মধ্যে অর্ধেক রাত যাপন না করে ফিরতি জাহাজে কক্সবাজার ফিরে গেছেন।

দ্বীপ ঘুরে দেখা গেছে, কঠোর বিধিনিষেধ মেনে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ করছেন পর্যটকেরা। পলিথিনের ব্যবহার, প্রবালসহ সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ, বারবিকিউ পার্টি ও রাতের সৈকতে হইচই নেই বললেই চলে। দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষার সরকার এমন পদক্ষেপে নেওয়ায় পর্যটকেরাও খুশি।