কুমিল্লার নিমসার বাজারে ২৫ টাকার সবজিতে খাজনা দিতে হতো ১০ টাকা

শাকসবজির পাইকারি বাজারে অভিযান চালায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্স। আজ রোববার সকালে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার নিমসার বাজারেছবি: প্রথম আলো

দেশের অন্যতম বড় শাকসবজির পাইকারি বাজার নিমসার। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার এই নিমসার বাজার থেকে শাকসবজিসহ বিভিন্ন কাঁচামাল নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিন ধরে ইজারাদার ও চাঁদাবাজদের কারণে অতিষ্ঠ এখানকার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।

ভুক্তভোগী লোকজনের ভাষ্য, কোনো কৃষক ২৫ টাকা মূল্যের কোনো সবজি বাজারে বসে বিক্রি করলে তাঁর কাছ থেকে খাজনার নামে চাঁদা নেওয়া হতো ১০ টাকা। আবার একই সবজি যে পাইকারি ব্যবসায়ী কেনেন, তাঁকেও দিতে হতো খাজনা। এভাবে বেপরোয়াভাবে খাজনা ও চাঁদা আদায়ের কারণে খুচরা পর্যায়ে শাকসবজির দাম হতো বেশি।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ রোববার সকালে নিমসার বাজারে অভিযান চালিয়েছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্স। অভিযানের নেতৃত্বে দেন জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) মাহফুজা মতিন। তিনি বলেন, অনিয়ন্ত্রিত খাজনা ও চাঁদা আদায়ের কারণে খুচরা বাজারে শাকসবজির দামের এই অবস্থা। এই বাজার থেকে খাজনা আদায় করা যাবে না মর্মে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এ ছাড়া যাঁরা ইজারা আদায় করতেন, তাঁদেরও কোনো বৈধতা ছিল না। যার কারণে আজ থেকে সব প্রকার খাজনা আদায়সহ চাঁদাবাজি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এত দিন যাঁরা অবৈধভাবে এসব কাজ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পাশাপাশি মাইকিং করে সবাইকে জানানো হয়েছে।

বুড়িচং উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, নিমসার বাজার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন মামলায় গত ১৫ জুলাইয়ের আদেশে স্থগিতাদেশ থাকায় আজ ২৭ অক্টোবর থেকে ইজাদারদের সব প্রকার ইজারা কার্যক্রম স্থগিত করা হলো। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া না পর্যন্ত সব ধরনের টোল আদায় বন্ধ থাকবে।

নিমসার বাজার থেকে চাঁদা ও খাজনা আদায় বন্ধের ঘোষণায় আনন্দ প্রকাশ করেছেন আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। খলিলুর রহমান নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে নিমসার বাজারে খাজনার নামে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলেছে। অবস্থাটা এমন হয়েছে যে এক আঁটি শাপলা ২৫ টাকা বিক্রি করলে ইজারাদারকে ১০ টাকা খাজনা দিতে হতো। কোনো কৃষক শাক নিয়ে এলেও আঁটিপ্রতি তিন থেকে পাঁচ টাকা দিতে হতো। বিশেষ করে আড়তদারদের বাইরে যাঁরা অস্থায়ী ব্যবসায়ী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাঁচামাল নিয়ে আসতেন, তাঁরাই বেশি বিপদে পড়তেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাজারের অন্তত পাঁচজন ব্যবসায়ী জানান, বিভিন্ন অজুহাতে নিমসার বাজারে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা খাজনা ও চাঁদা আদায় করা হতো। এই বাজার থেকে সবজি কেনাবেচা করলে খাজনা, টোল ও চাঁদার নামে তিনবার টাকা দিতে হয়। বাজারে যিনি পণ্য বিক্রি করেন তাঁকে খাজনা দিতে হয়, আবার যিনি কিনছেন, তাকে চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া একই পণ্য পরিবহনের জন্য আবার পৃথক টোল দিতে হতো। এতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন ব্যবসায়ী ও কৃষকেরা।
স্থানীয় কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, নিমসার বাজারে সামান্য লালশাক নিয়ে এলেও ৩ টাকা প্রতি আঁটিতে খাজনা নিতেন তাঁরা। তিনি ঝুড়িতে করে ১০০ আঁটি শাক আনলে ৩০০ টাকা দিতে হতো। আবার যে খুচরা ব্যবসায়ী এখান থেকে কিনে নিয়ে যান, তাঁকেও একই রকম চাঁদা দিতে হয়। পুরো বাজারের একই অবস্থা।

কুমিল্লা নগরের বাদশা মিয়ার বাজারের ব্যবসায়ী ফরিদ হোসেন বলেন, খাজনা ও চাঁদার কারণে দীর্ঘদিন ধরে শাকসবজির দাম লাগামহীন। এসব বন্ধ হয়ে গেলে খুচরা বাজারে এর সুফল মিলবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কুমিল্লা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আছাদুল ইসলাম বলেন, নিমসার বাজার দেশের অন্যতম বৃহৎ শাকসবজির পাইকারি বাজার। এখানে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকলে খুচরা পর্যায়ে দাম অনেক কমে যাবে। কিন্তু বিগত সময়ে এখানে বেপরোয়াভাবে খাজনা ও চাঁদা আদায় করায় খুচরা বাজারে মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। আজ সকালে টাস্কফোর্সের অভিযানে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, সব প্রকার খাজনা আদায় বন্ধ করা হয়েছে। এতে আশা করছেন, আজ থেকেই মানুষ এই সিদ্ধান্তের সুফল পাবেন।