নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছায়নি সহায়তা
উজান থেকে ধেয়ে আসা পানির চাপ বাড়তে থাকার পাশাপাশি নতুন করে ব্যাপক বৃষ্টির ফলে নোয়াখালীর সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এতে জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে আটটিতেই বন্যার পানি বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জেলার সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সদর, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলার বন্যার পানি। এসব উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সরকারি–বেসরকারি কোনো ত্রাণই এখন পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ফলে এলাকার বন্যার্ত মানুষ সীমাহীন কষ্টে দিন যাপন করছেন।
এদিকে জেলায় বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে পাঁচজনে দাঁড়িয়েছে। গতকাল জেলার সেনবাগ উপজেলার কেশারপাড় ইউনিয়নে বন্যার পানিতে ডুবে মো. আবদুর রহমান (২) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার কেশারপাড় ইউনিয়নের বীরকোট পশ্চিম পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। আবদুর রহমান কেশারপাড় ইউনিয়নের বীরকোট পশ্চিম পাড়ার মো. গিয়াস উদ্দিনের ছেলে।
জেলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রোববার সকাল নয়টা থেকে আজ সোমবার সকাল নয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলা শহর মাইজদীতে ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। আজ সকাল থেকেও বৃষ্টি হচ্ছিল। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের প্রভাবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় জেলায় বৃষ্টি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে এখানকার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জেলার আটটি উপজেলা ও সাতটি পৌরসভা বন্যাকবলিত। এসব এলাকার ১ হাজার ৯৮টি স্থায়ী ও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে এরই মধ্যে ১ লাখ ৮২ হাজার ৩০৯ জন আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যায় পানিবন্দী হয়ে আছেন জেলার ১৯ লাখ ৮১ হাজার ৭০০ জন। বন্যার্ত মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ৮৮টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলা শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর, কৃষ্ণরামপুর, দত্তেরহাট ও সোনাপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি এলাকা হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে ডুবে আছে। সড়কগুলো তলিয়ে গেছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং জজ আদালত ও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণেও হাঁটুপানি। বন্যার পানির কারণে গোটা শহরের বাসিন্দারাই পানিবন্দী অবস্থায় নিদারুণ কষ্টে দিন যাপন করছেন। শহরের প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যার্ত মানুষের ভিড়।
বন্যার্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা শহর ও বিভিন্ন উপজেলার যেসব সড়কে তুলনামূলক বন্যার পানি কম ওই সব এলাকার নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে এবং বাসাবাড়িতে আটকে পড়া লোকজন কমবেশি সরকারি–বেসরকারি ত্রাণ পাচ্ছেন। কিন্তু জেলা ও উপজেলা এবং ইউনিয়ন সড়ক থেকে দূরবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামের বেশির ভাগ বাসিন্দা সহায়তা পাননি। বন্যার পানি বেশি হওয়া তাঁদের কাছে কেউই ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন না।
সেনবাগ উপজেলার কেশারপাড় ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. মামুন আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। এলাকার অবস্থা খারাপ শুনে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিলেন নিজের পরিবার-পরিজনকে উদ্ধার করতে। এসে দেখেন পুরো এলাকা হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে ডুবে আছে। গতকাল রাতের বৃষ্টিতে পানি আরও বেড়েছে। সেনবাগ-সোনাইমুড়ী সড়কের ওপর হাঁটুসমান পানি। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু পরিবারকে ত্রাণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু এলাকায় অনেক পরিবার রয়েছে, যারা চার-পাঁচ দিন ধরে সামান্য শুকনা খাবার খেয়ে আছেন। কেউ আছেন না খেয়ে।
সেনবাগ উপজেলার উত্তর কাদরা গ্রামের ওছমান গণি বলেন, তাঁদের বাড়ির কাছে কাদরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পাশের একটি মাদ্রাসায় ৫০০ বন্যার্ত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন তাঁরা। এত দিন চাঁদা তুলে তাঁদের দুই বেলা খাবার দিয়েছেন। আর খাবার দেওয়ার মতো টাকাও তাঁদের কাছে নেই। অনেক বাড়ির বাসিন্দা এখনো পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। কোথায়ও যাওয়ার মতো জায়গা নেই তাঁদের। তাই ওই এলাকাতে দ্রুত ত্রাণসামগ্রীর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে আটটিই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন আটটি উপজেলা বন্যার পানিতে ডুবে আছে। এর মধ্যে সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, বেগমগঞ্জ, চাটখিল ও সদর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি সব চেয়ে খারাপ। বন্যায় জেলায় এ পর্যন্ত পানিতে ডুবে এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সেনবাগ উপজেলায় তিনজন, সদরে একজন ও বেগমগঞ্জ উপজেলায় একজন মারা গেছেন।