ভালুকায় পোশাক কারখানায় একসঙ্গে অসুস্থ ৭১ শ্রমিক, চিকিৎসক বলছেন ‘গণমনস্তাত্ত্বিক রোগ’

এল এসকোয়্যার লিমিটেড কারখানার অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকালে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে
ছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের ভালুকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করার সময় অন্তত ৭১ শ্রমিক একসঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার স্কয়ার মাস্টারবাড়ি এলাকার এল এসকোয়্যার লিমিটেড নামের তৈরি পোশাক কারখানায় এ ঘটনা ঘটে।

অসুস্থ শ্রমিকদের মধ্যে ৩১ জনকে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ৩০ জনকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে এর মধ্যে কোনো শ্রমিকের অবস্থা আশঙ্কাজনক নয় বলে জানা গেছে।

এল এসকোয়্যার কারখানা সূত্রে জানা যায়, আজ সকাল আটটার দিকে শ্রমিকেরা কারখানায় কাজে যোগ দেন। এর মধ্যে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ অসুস্থ শ্রমিকদের মাস্টারবাড়ি পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যায়। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলে কিছু শ্রমিককে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও নিয়ে যাওয়া হয়। দুটি হাসপাতালে ৭১ শ্রমিক অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন।

কারখানাটিতে কাজ করেন জাকিয়া সুলতানা। তিনি ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘কাজে যোগ দেওয়ার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে অচেতন হয়ে পড়ি। কী কারণে এমনটি হয়েছে, বলতে পারি না।’ আরেক শ্রমিক রোমান মিয়া বলেন, ‘কাজ শুরুর কিছুক্ষণ পর কয়েকজন নারী অচেতন হয়ে পড়েন। তাঁদের মাথায় পানি ঢেলে হাসপাতালে পাঠানোর পর ধীরে ধীরে আরও অনেকে অসুস্থ হতে শুরু করেন। আমাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হঠাৎ মাথায় কেমন লাগার পর অচেতন হয়ে যাই, আর কিছু বলতে পারি না।’

ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হাসানুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিক থেকে অসুস্থ শ্রমিকেরা আসতে শুরু করেন। মোট ৩১ জনকে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে বেলা তিনটা নাগাদ ২৪ জন ছাড়পত্র নিয়ে চলে গেছেন, বাকিরা ভর্তি আছেন। তিনি বলেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের কারও মাথা ঘুরাচ্ছিল, কারও বমি বমি লাগছিল, কারও শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, অনেকের পূর্ণ চেতনা ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা গণমনস্তাত্ত্বিক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। ভয় থেকে বা গরম থেকে নারীরাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হন। একজনের দেখাদেখি অন্যদের মধ্যেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে।

ময়মনসিংহের ভালুকায় এল এসকোয়্যার লিমিটেড কারখানার ফটক
ছবি: সংগৃহীত

এল এসকোয়্যার লিমিটেড কারখানার মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মো. মনির হোসেন বলেন, সকাল ১০টার দিকে শ্রমিকেরা অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন। যে ফ্লোরে শ্রমিকেরা অসুস্থ হন, সেখানে ১ হাজার ২০০ শ্রমিক কাজ করছিলেন। তাঁদের কোম্পানিতে মোট ৩ হাজার ৩০০ শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু একটি ফ্লোরেই সমস্যাটি দেখা দেয়। তিনি বলেন, ‘প্যানিক অ্যাটাকে’ শ্রমিকেরা অসুস্থ হন। এর মধ্যে নারীই বেশি। কারখানার বাইরে চাকরিপ্রত্যাশীদের ঝামেলা চলার প্রভাব শ্রমিকদের মধ্যে পড়তে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আজকের জন্য কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আহমাদ মাসুদ বলেন, খবর পেয়ে ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল কারখানায় পাঠানো হয়েছে। তারা পুরো ঘটনা যাচাই-বাছাই করে রাতে প্রতিবেদন জমা দেবে। তারপর বলা যাবে, কী কারণে এমনটি হয়েছে। প্রতিনিধিদলকে শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, পানি খাওয়ার পর অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন। ‘প্যানিক’ থেকে এমনটি হতে পারে। চিকিৎসকেরা এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ পাননি।

ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলীনূর খান বলেন, শ্রমিকেরা অসুস্থ হতে শুরু করলে তাঁদের হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালে কিছুক্ষণ থাকার পর সুস্থ হতে শুরু করলে বেশির ভাগ শ্রমিক প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় চলে যান। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এমন ঘটনার পেছনে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানতে পারেননি। তবে চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়েছেন, শ্রমিকেরা যে পানি পান করেন, তার নমুনা পরীক্ষা করার জন্য। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে বলা হয়েছে কারখানার কর্মপরিবেশ ও ভেন্টিলেশন ঠিক আছে কি না দেখার জন্য। চিকিৎসকেরা বলছেন, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে এমনটি হয়েছে। কিন্তু সবাই একসঙ্গে আতঙ্কিত হওয়ার কথা নয়। ইউএনও বলেন, ‘আমরা জানার চেষ্টা করছি, অন্য কোনো বিষয় এর মধ্যে রয়েছে কি না।’

ময়মনসিংহের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মাহফুজুল আলম মাসুম বলেন, কী কারণে শ্রমিকেরা অসুস্থ হয়েছেন, তা খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।

এর আগে চলতি বছরের ১০ থেকে ১৩ জানুয়ারি ভালুকার জামিরদিয়া মাস্টারবাড়ি এলাকার এসকিউ গ্রুপের গার্মেন্টসে গণমনস্তাত্ত্বিক রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রথমে শ্রমিকেরা অসুস্থ হতে শুরু করেন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠিত হওয়া তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কোম্পানিটিতে নানা ত্রুটির কারণে শ্রমিকদের অসুস্থ হওয়া ও মৃত্যুর কথা বলা হয়েছিল।