বুড়িতিস্তা জলাধার প্রকল্প: কৃষকেরা বলছেন, ‘‌জান দিব, জমি দিব না’

জলাধার নির্মাণের প্রতিবাদ করে আসছেন স্থানীয় কৃষকেরা। নির্মাণকাজে বাধা দেওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা হয়েছে।

নীলফামারীর বুড়িতিস্তার বিশাল এলাকায় সেচ সম্প্রসারণে জলাধার তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। অধিগ্রহণকৃত এলাকার অংশবিশেষ। গত মঙ্গলবারের ছবিপ্রথম আলো

চারদিকে সবুজের সমারোহ। চলছে চাষাবাদ। আর ওই জমিতে বুড়িতিস্তা ব্যারাজকে ঘিরে চলছে বিশাল জলাধার নির্মাণের উদ্যোগ। প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে নীলফামারীর জলঢাকা ও ডিমলা উপজেলার মানুষ। তাঁদের বিরুদ্ধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দিয়েছে ১০টি মামলা। আসামি করা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার মানুষকে। তাই গ্রামবাসী সংগঠিত হয়ে গড়ে তুলেছেন কৃষক সমবায় সমিতি। সংগঠনটির সদস্যরা বলছেন, ‘‍জান দিব, জমি দিব না’। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রকল্পটি।

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, নীলফামারীর কালীগঞ্জ এলাকার বুড়িতিস্তা ব্যারাজ এলাকার পাঁচটি মৌজার ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে ভুট্টা, আলু, মরিচ, পেঁয়াজ, শর্ষেসহ বিভিন্ন রবিশস্য। কিছু কিছু জমিতে আমন ধানের নাড়া পড়ে আছে। ওই জমিগুলোতে নতুন করে ফসল আবাদ হবে। 

ডিমলা সদর ইউনিয়নের কুঠিরডাঙ্গা গ্রামের কৃষক মনছের আলীর (৭০) বলেন, ষাটের দশকে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার কুঠিরডাঙ্গা, রামডাঙ্গা, পঁচারহাট, জলঢাকার গোলনা ইউনিয়নের চিড়াভাজা, গোলনা ও খারাজি গোলনা গ্রামের ৩ হাজার ১৫৮ হেক্টর জমিতে সেচসুবিধা দিতে বুড়িতিস্তা নদীতে ব্যারাজ করা হয়। ব্যারাজে যুক্ত করা হয় ১৪টি স্লুইস গেট। তৎকালীন সরকার ওই সময় কৃষকদের কাছ থেকে ১০৪ একর জমি অধিগ্রহণ করে; কিন্তু প্রকল্পটি কোনো কাজে আসেনি; বরং ব্যারাজের কারণে সন্নিবেশিত এলাকার কয়েক হাজার একর জমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। পাঁচ বছর কোনো আবাদ করা যায়নি। এ কারণে ১৯৬৯ সালে তৎকালীন সরকার কৃষকদের কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল।

পাউবো ওই জমি নিজেদের দাবি করলেও কখনো অধিগ্রহণ করা হয়নি। আমরা আমাদের জমিতে জলাধার করতে দিব না। 
মনছের আলী, স্থানীয় কৃষক 

পাউবো কৃষককে আবার ‘ডুবিয়ে মারা’র ষড়যন্ত্র করছে দাবি করে মনছের আলী বলেন, ‘বুড়িতিস্তা ব্যারাজকে কেন্দ্র করে ১ হাজার ২১৭ হেক্টর জমিতে জলাধার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। পাউবো ওই জমি নিজেদের দাবি করলেও কখনো অধিগ্রহণ করা হয়নি। আমরা আমাদের জমিতে জলাধার করতে দিব না।’

নীলফামারী পাউবো সূত্রে জানা যায়, পাকিস্তান আমলে ডিমলা ও জলঢাকা থানার ১ হাজার ২১৭ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ওই জমিতে জলাধার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ৩ হাজার ১৫৮ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে। 

কৃষক সমবায় সমিতির সভাপতি জয়নাল আবেদীনের ভাষ্য, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে। আমরা প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা দিয়েছি। আমরা কোনোভাবেই আবাদি জমিতে জলাধার করতে দিবো না। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এলাকার এলাকার তিন হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়বে। সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ফলে কৃষি অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে।’

নীলফামারী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান বলেন, ‘বুড়িতিস্তা ব্যারাজের জলাধার করতে গিয়ে আমরা বাধার শিকার হচ্ছি। ওই এলাকার ১ হাজার ২১৭ দশমিক ৬১ একর জমি ইতিমধ্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ওই জমিতে কাজ করতে গিয়ে আমরা হামলার শিকার হয়েছি। এ জন্য ডিমলা থানায় একটি, জলঢাকা থানায় ছয়টি ও আদালতে তিনটি মামলা করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এলাকাবাসী লাভবান হবেন। অথচ তাঁরা না বুঝে প্রকল্পে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।’

পাকিস্তান আমলে ডিমলা ও জলঢাকা থানার ১ হাজার ২১৭ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ওই জমিতে জলাধার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ৩ হাজার ১৫৮ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে।

জলঢাকা উপজেলার গোলনা ইউনিয়নের চিড়াভাজা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রশীদ বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদার জমিতে কিসের আশায় পানি উন্নয়ন বোর্ড জলাধার করতে চায়, তা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। এ প্রকল্প আমরা চাই না।’

বুড়িতিস্তা খননকাজ দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে বলে জানিয়েছেন নীলফামারী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘পানি উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আমাদের সহযোগিতা চেয়েছেন। অপর দিকে এলাকা প্রকল্পের কাজ বন্ধের দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছে। আমরা চাই, উভয় পক্ষ বসে একটা সুষ্ঠু সমাধান হোক। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’