অটোরিকশায় করে কিশোরীকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন দুই তরুণ, লাফ দিয়ে প্রাণে রক্ষা
উপজেলা সদর থেকে নিজের বাড়িতে যাওয়ার জন্য একটি অটোরিকশায় ওঠে কিশোরী (১৬)। একই এলাকায় যাবেন বলে দ্রুত তার দুই পাশে আরও দুই যুবক ওঠে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে চালক অটোরিকশা চালু করেন। কিছু দূর যাওয়ার পরই মেয়েটি বুঝতে পারে তাকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন অটোরিকশা থামাতে বললে দুই পাশের যুবকেরা তার মুখ চেপে ধরেন। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে থাকে ওই কিশোরী।
এভাবে অন্তত ১০ কিলোমিটার যাওয়ার পর মেয়েটি অটোরিকশা থেকে লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়ে নিজেকে রক্ষা করে। চলন্ত অটোরিকশা থেকে পড়ে গুরুতর আহত কিশোরী এখন হাসপাতালে ভর্তি। তাঁর ডান চোখ, কপাল, গাল, হাত থেঁতলে গেছে। চোখের অবস্থা ভালো নয় বলে পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মেয়েটির হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। কী করবেন, কার কাছে যাবেন, বুঝতে পারছেন না মেয়েটির কৃষক বাবা। একধরনের ভয় ও আতঙ্ক পরিবারের সবার চোখেমুখে।
আজ শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে এলাকার একজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বিষয়টি জানান। এরপর সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মেয়েটি হাসপাতালে ভর্তি আছে। সঙ্গে বাবা, চাচাসহ প্রতিবেশী কয়েকজন রয়েছেন। মেয়েটির মুখের ডান পাশ থেঁতলে আছে। ডান চোখের চারপাশ ফুলে বন্ধ হয়ে গেছে চোখ। খুব ব্যথা করছে বলে জানায় সে। মেয়েটির বরাত দিয়ে হাসপাতালের দায়িত্বরত নার্স বলেছেন, কিশোরীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মেয়েটি বলে, দিরাই পৌর শহর থেকে তাদের গ্রামের দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার। গ্রাম থেকে তারা অটোরিকশা কিংবা লেগুনাতেই দিরাই শহরে যাতায়াত করে। বৃহস্পতিবার দুপুরে কাপড় কেনার জন্য সঙ্গে দুজনকে নিয়ে দিরাই পৌর শহরে আসে সে। অন্য দুজনের কেনাকাটা শেষ হওয়ায় তারা আগেই বাড়ি চলে যায়। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মেয়েটি কেনাকাটা শেষে বাড়িতে যাওয়ার জন্য দিরাই বাসস্ট্যান্ডে যায় লেগুনার জন্য। সেখানে তখন মানুষের ভিড় বেশি ছিল। তখন বাড়ি যাওয়ার জন্য অটোরিকশা ভাড়া করে মেয়েটি।
মেয়েটি জানায়, অটোরিকশায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুই তরুণ (১৮-২০ বছর বয়স হবে) ওই এলাকায় যাওয়ার কথা বলে দুই দিকে ওঠে পড়েন। এরপরই চালক অটোরিকশা চালিয়ে দেন। কিছু দূর যাওয়ার পরই মেয়েটি দেখতে পায়, অটোরিকশা সুনামগঞ্জ শহরের দিকে যাচ্ছে। তখনই অটোরিকশা থামাতে বলে চালককে। এ কথা বলার পরই পাশে থাকা দুজন তাকে ঝাপটে মুখ চেপে ধরেন। মুঠোফোন কেড়ে নেন। তখন মেয়েটি তাঁদের সঙ্গে ধস্তাধাস্তি শুরু করে। এভাবে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে অটোরিকশা দিরাই-মদনপুর সড়কের গণিগঞ্জ এলাকায় আসে। তখন মাগরিবের আজান হয়ে যায়। এ সময় জোরে ধাক্কা দিয়ে ওই দুই তরুণকে কোনো রকমে ছাড়িয়ে মেয়েটি চলন্ত অটোরিকশা থেকে লাফ দিয়ে রাস্তায় পড়ে। এরপর অটোরিকশা দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়।
ওই কিশোরীর বাবা জানান, সন্ধ্যায় হওয়ার পরও তাঁর মেয়ে বাড়ি না ফেরায় তিনি মুঠোফোনে কল করেন, কিন্তু সংযোগ বন্ধ পান। রাত ৯টার দিকে এক আত্মীয় ঢাকা থেকে ফোন করে জানান, মেয়েটিকে দিরাই-মদনপুর সড়কের গণিগঞ্জ এলাকায় আহত অবস্থায় সড়কের পাশে পাওয়া গেছে। সেখানে একজনের বাড়িতে রাখা হয়েছে। এরপর তাঁরা গিয়ে মেয়েকে সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। রাত ১১টায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মেয়েটি রাস্তায় অনেকক্ষণ অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে ছিল। কেউ তাকে উদ্ধার করেনি। একপর্যায়ে জ্ঞান ফেরার পর যখন সে ঘটনা ও ঠিকানা জানায়, তখনই তাকে একজনের বাড়িতে নেওয়া হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা ও একটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক লিটন রঞ্জন তালুকদার বলেন, ‘মেয়েটি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে বলে জেনেছি। এরা খুবই নিরীহ মানুষ। বাবা কৃষক। আমাকে জানানোর পর হাসপাতালে এসে দেখি, মেয়েটির অবস্থা খুবই খারাপ। পরে আমিই ফোন করে দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ঘটনাটি জানিয়েছি।’
দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কেউ ঘটনা আগে জানায়নি। শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সুনামগঞ্জ শহর থেকে একজন শিক্ষক ফোনে জানিয়েছেন। আমরা ঘটনার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি।’
রাত পৌনে নয়টায় সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকির হোসেন জানিয়েছেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ইমন খানকে (২৫) নামে এক অটোরিকশাসহ চালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর বাড়ি দিরাই উপজেলার জকিনগর গ্রামে।