কুমিল্লায় ট্রেন দুর্ঘটনা
চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা শাহিনুর, বাড়িতে ফিরল তাঁর ছিন্নবিচ্ছিন্ন মরদেহ
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর এলাকায় গতকাল মঙ্গলবার ট্রেনের ধাক্কায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় সাতজন নিহত হয়েছেন। তাঁদের একজন শাহিনুর আক্তার (৩৫)। অন্তঃসত্ত্বা এই নারীর মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমেছে।
নিহত শাহিনুর আক্তার বাকশিমূল গ্রামের বাসিন্দা মনির হোসেনের স্ত্রী। পরিবারের সদস্যরা জানান, শাহিনুর আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। গতকাল সকালে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে পাশের গাজিপুর বাজারে পল্লিচিকিৎসকের কাছে রওনা হন। যাওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, দ্রুত বাড়ি ফিরে আসবেন। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চড়েছিলেন শাহিনুর। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কালিকাপুর এলাকায় সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশাটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঘর থেকে বের হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই শাহিনুর বাড়ি ফিরেছেন। তবে তাঁর দেহে ছিল না প্রাণ। ট্রেনের ধাক্কায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসেন স্বজনেরা।
শাহিনুরের স্বামী মনির হোসেন কৃষিকাজ করেন। এ দম্পতি ১০ বছরের একটি ছেলে আছে। গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে মনিরের বাড়িতে প্রবেশ করতেই একটি টিনের ঘর চোখে পড়ে। সেই ঘরের সামনেই পর্দা টানিয়ে শাহিনুরকে শেষবিদায় দিতে গোসল করানো হচ্ছিল। শেষবিদায়ের বাহন খাটিয়াও প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল পাশেই। ঘরের সামনে মাটিতে বসে বিলাপ করছিলেন স্বজনেরা। তাঁদের মধ্যে মনিরের ছোট বোন সোনিয়া আক্তারের কান্না কিছুতেই থামছে না।
বিলাপ করতে করতে সোনিয়া বলেন, ‘শানু আমার ভাবি না, আমার বইন আছিল। আমার বইনডা এভাবে চলে যাইব ভাবতেও পারতাছি না। এক মাস পরেই তাঁর ডেলিভারির ডেইট আছিল। আমরার সব শেষ হইয়া গেল। অনেক ভালা মানুষ আছিল আমার বনইডা।’
মনির হোসেন নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। একপর্যায়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি বাড়ির পাশে কাজ করতেছিলাম। বউডার শরীর ভালো না। এর লাইগ্যা কইছি ডাক্তারের কাছে যাইতো। আমি কি জানতাম, আমার বউডা লাশ হইয়া বাড়িত আইবো। গত মাসে আলট্রা (আল্ট্রাসনোগ্রাম) করছি। ডাক্তার কইসে আমরার মেয়ে হইবো। এর আগেও আমারে একটা মেয়ে দিসিলো আল্লাহ পাকে। হেই সন্তানডা দুই দিনের মাথায় মইরা গেছিলো। নামও রাখতাম পারছি না। এহন আবার মেয়ে হইব, এইডা শুইন্যা আমরা খুব খুশি আছিলাম। কিন্তু ভাবি নাই, আমার সব শেষ হইয়া যাইব। এহন আমি কি লইয়া থাইক্কাম।’
মনির হোসেনের চাচা মো. শাহজাহান বলেন, ‘শাহিনুর আক্তার শানু খুবই ভালো মেয়ে ছিল। আমাদের বাড়ির সবাই তাঁর ব্যবহারে সন্তুষ্ট ছিল। গ্রামের মানুষও তাঁকে ভালো জানত। তাঁর এমন মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারছে না। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় পেটের মধ্যেই আট মাসের সন্তানটাও মারা গেছে। ট্রেনের ধাক্কায় তাঁর শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওই স্থানে একটি বৈধ গেট স্থাপন ও গেটম্যান নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি।’
বুড়িচং উপজেলার বাকশিমূল ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের ওপর দিয়ে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ। বাকশিমূল গ্রাম থেকে কালিকাপুর হয়ে গাজিপুর বাজার সড়কটি গেছে রেলপথের ওপর দিয়ে। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ট্রেনের ধাক্কায় একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় থাকা সাতজন নিহত হন। তাঁদের পাঁচজনের বাড়ি বাকশিমূল গ্রামে। অন্য দুজনের বাড়ি পাশের খোদাইধুলি গ্রামে।