‘সংখ্যালঘু মানুষ, সব সময় আতঙ্কে থাকি, মামলা করে শত্রু হতে চাই না’
শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ৫ ও ৬ আগস্ট নওগাঁ শহরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তত ২৪টি বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে আছেন হিন্দুধর্মাবলম্বী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন এমন হিন্দু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকজন। এসব ঘটনায় গত দুই সপ্তাহে আইনি প্রতিকার চেয়ে কোনো ভুক্তভোগী মামলা কিংবা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেননি।
৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত নওগাঁয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মানুষের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৮৬টি। এর মধ্যে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ২৪টি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত যাঁদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে, তাঁরা হলেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও নওগাঁ-১ আসনের সংসদ সদস্য সাধন চন্দ্র মজুমদার, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক বিমান কুমার রায়, জেলা মহিলা লীগের সহসভাপতি সোমা মজুমদার, নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উৎপল কুমার, একই উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মনোরঞ্জন মজুমদার, মান্দা উপজেলার গণেশপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সামন্ত লাল সরকার, মান্দার ভারশো ইউনিয়ন আওয়ামী লীগর সদস্য ও ইউপি সদস্য জয়ন্ত কুমার সরকার, মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও সাংবাদিক গৌতম কুমার, সাপাহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মন্মথ সাহা এবং সাপাহার সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোপাল চন্দ্র মণ্ডল। এই ১০ আওয়ামী লীগ নেতার যেসব সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো সরেজমিন দেখেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। আওয়ামী লীগের এসব নেতা বর্তমানে আত্মগোপনে আছেন। বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় থানায় কোনো মামলা কিংবা জিডি করেননি তাঁরা।
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন, নওগাঁয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এমন ব্যক্তিদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাটের ১৪টি ঘটনার খবর পেয়েছে প্রথম আলো। এর মধ্যে ৫ আগস্ট বিকেলে নওগাঁর ব্যবসায়ী পরিতোষ মণ্ডলের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এর মধ্যে আছে একটি কোল্ডস্টোরেজ, একটি রেস্তোরাঁ ও একটি বহুতল ভবনের মালামাল।
পরিতোষ কুমারের ছেলে সুমার কুমার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত আমাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লাঠি, রড হাতে শত শত লোকজন লুটপাট চালায়। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে আমাদের কর্মচারীরা মারধরের শিকার হয়েছে। স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, এমন কাউকে সেদিন দেখিনি। সন্ত্রাসীরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের মালামাল থেকে শুরু করে সেখানে থাকা আসবাবপত্র পর্যন্ত লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এতে আমাদের প্রায় ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
৬ আগস্ট সকালে মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর বাজারে মেসার্স সুনীল ট্রেডার্সের কীটনাশকের গুদামে লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী সুনীল প্রামাণিকের দাবি, দুর্বৃত্তরা তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের শাটার ভেঙে ভেতরে ঢুকে দোকানে থাকা সব কীটনাশক লুট করে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া দোকানে থাকা চেয়ার, টেবিল, ফ্যানসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে গেছে।
এ ঘটনায় তাঁর ৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক দলের পদে ছিলাম না। কোনো দিন মিছিল-মিটিংয়ে যাইনি। তারপরেও আমার এত বড় ক্ষতি কেন করল, বুঝলাম না।’ এ ঘটনার পর মামলা না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সংখ্যালঘু মানুষ আমরা। এমনিতেই সব সময় আতঙ্কে থাকি। তারপর মামলা করে মানুষের শত্রু হতে চাই না। যা ক্ষতি হওয়ার হইছে। ভগবানের কাছে বিচার দিছি, তিনি যেন এর বিচার করেন।’
৬ আগস্ট ধামইরহাট উপজেলার আগ্রাদ্বিগুণ ইউনিয়নের কাউয়াকুড়ি গ্রামে নওগাঁ জেলা আদিবাসী পরিষদের সদস্য তারামনি তিগ্যার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় একদল দুর্বৃত্ত। দুর্বৃত্তরা তারামনি তিগ্যার বাঁশ ও খড়ের বেড়ার বাড়িটি ভেঙে দেয়। তারামনি বর্তমানে পরিবার নিয়ে অন্যের বাড়ির বারান্দায় থাকছেন।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘৬ আগস্ট রাত ৮টার দিকে ২০ থেকে ২৫ জন লোক অ্যাসে হামার বাড়িত হামলা করে। তখন বাড়িত হামি, হামার স্বামী, ছোট ছেলে ও আর ওর বউ আছিনু। ওরা অ্যাসেই শুরুতে হামাক মারধর করা শুরু করে। এরপর কোনো রকম হামরা দৌড়ে পালিয়ে অন্য একজনার বাড়িত লুকায়ে প্রাণ বাঁচাই। ওরা হামার ঘরেত থাকা চাল থেকে শুরু করে সব মালামাল লুট করে লিয়ে গেছে। বাড়ি ভ্যাঙে দিলে মাটির সাথে মিশে দিছে। এখন অন্যের বাড়ির বারান্দায় চারজন লোক কষ্ট করে থাকোছি।’ এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘যারা হামলা করিছি, তাদেরকে ছিনতে পারিছি। ওরা বিএনপি করে।’
সুনীল প্রামাণিক, তারামনি, পরিতোষ কুমারসহ নওগাঁয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত নন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এমন অন্তত ১৪টি হামলা, ভাঙচুরের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এসব ঘটনার মধ্যে মান্দা উপজেলার সতিহাট বাজারে সামন্ত কুমার সরকারের মালিকানাধীন সততা ট্রেডার্স নামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, সতিহাট বাজারে জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি রাম চন্দ্র মণ্ডলের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট ও ভাঙচুর, অপূর্ব কুমারের মালিকানাধীন অপূর্ব স্টোর নামের প্রতিষ্ঠান থেকে মালামাল লুটপাট ও ভাঙচুর এবং উপজেলার পীরপাল বাজার জয়ন্ত কুমারের বাড়ি ও তাঁর মালিকানাধীন মুদিদোকানে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়।
এ ছাড়া পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর বাজারে দিলীপ কুমারের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়। নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা ইউনিয়নের গাবতলী বাজারে আনন্দ কুমারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং উপজেলার চন্দননগর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর তলা খরপা গ্রামে যতীন উড়াও নামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এক ব্যক্তির বাড়িতে হামলা ও তাঁর পুকুরের মাছ লুটপাট করা হয়। সাপাহার বাজারে পরিমল চন্দ্র নামের এক হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ীর গোডাউনে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে।
এ ছাড়া জেলার বদলগাছী উপজেলার সদরের লক্ষ্মীকুল মিশন আদিবাসী পাড়ায় ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় মোটরসাইকেল নিয়ে আসা একদল সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী চার ব্যক্তিকে কুপিয়ে জখম করে। সরেজমিন পরিদর্শন, ভুক্তভোগী, স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এসব ঘটনা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার বলেন, ‘নজিপুর বাজারে আমার বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, তারসহ বিভিন্ন ইলেকট্রিকস পণ্যের দোকান। ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় প্রায় দেড় থেকে দুই শ লোক আমার দোকানের শাটার ভেঙে ভেতরে ঢুকে দোকানের মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। ওই দিন আমার প্রায় ২০ লাখ টাকার মালামাল লুট হয়েছে। মামলা করে কোনো প্রতিকার পাওয়ার আশা নেই। তাই থানায় কোনো মামলা করিনি।’
সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর ঘটনা ছাড়াও নওগাঁ শহরে খ্রিষ্টান চার্চ অব বাংলাদেশ মিশনের গির্জায় অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। নওগাঁ খ্রিষ্টান চার্চ অব বাংলাদেশ মিশন গির্জার ফাদার রেভারেন্ট সর্বানন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ৬ আগস্ট ভোর চারটার দিকে গির্জায় কে বা কারা আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে। আগুনে গির্জার সামনের অংশের বারান্দায় থাকা দুটি চেয়ার ও একটি বেঞ্চ পুড়ে যায়। এ ছাড়া মেঝেতে বিছানো কার্পেটের কিছু অংশ পুড়ে যায়। আগুন দেখতে পেয়ে দ্রুত তা নেভানো হয়। এ সময় চার্চের প্রধান দরজায় তালা দেওয়া ছিল। মনে হচ্ছে, দুর্বৃত্তরা চার্চের প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
৫ আগস্ট ও এর পর থেকে এখন পর্যন্ত নওগাঁয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় অন্তত ২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন জেলা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি রামচন্দ্র মণ্ডল। যাঁরা এসব ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাঁদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানান তিনি।