‘এমন স্রোতে পানি আইছে, ঘরের ভিডির মাটি পর্যন্ত ধুইয়া গেছে’
সামসুন্নাহারের বাড়ি পটুয়াখালীর সদর উপজেলার ছোটবিঘাই ইউনিয়নের পায়রা নদীর পাড়ে মাটিভাঙ্গা গ্রামে। স্বামী মনির গাজী দিনমজুর। সাইফুল (১৪), লামিয়া (৭) ও রায়হান (৬) এই তিন সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাত আনার দিন বাঁধের পাড়ে ছোট্ট ঘরে ছিলেন সামসুন্নাহার। রাতে জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ভেসে যেতে থাকে ঘরের মালামাল। সঙ্গে ছিল ঝোড়ো হাওয়া।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝড়বৃষ্টি আরও বাড়তে থাকে। ঘরের পাশে বাঁধের বড় বড় গাছ উপড়ে পড়তে থাকে। এমনকি বিদ্যুতের খুঁটিও ভেঙে পড়ে। এই অবস্থায় স্বামী মনির সন্তানদের নিয়ে পানি ভেঙে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ওঠেন। কিন্তু সামসুন্নাহার বাড়িতে রয়ে গিয়েছিলেন। পরে টিকতে না পেরে রাতে তিনিও গলা পর্যন্ত পানি ভেঙে সাঁতরে আশ্রয়কেন্দ্রে যান।
সামসুন্নাহার বলেন, ‘বইন্যার পানি বাঁধের ওপর দিয়ে আইছে। এমন স্রোতে পানি আইছে, ঘরের ভিডির মাটি পর্যন্ত ধুইয়া গেছে। ঘরের সবকিছু স্রোতে নিতে থাকে। ধইরাও রাখতে পারি নাই। বাঁধ ভাইঙ্গা পানিতে সব ভাইস্যা গেছে।’
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে সামসুন্নাহারের ঘরের সামনে বাঁধ ভেঙে জোয়ারের জলোচ্ছ্বাসের পানি সরাসরি তাঁদের ঘরের চলে আসে। স্রোতের তোড়ে ঘরের ভেতরের মাটি পর্যন্ত ধসে যায়। ঘরের ভিটে না থাকায় এখন চরম দুর্ভোগ নিয়ে দিন কাটছে সামসুন্নাহারের।
সামসুন্নাহারের ঘরের পাশে পানু দাসের (৬০) ঘর। ঝড়ের রাতে জলোচ্ছ্বাসে তাঁর বসতঘরটিও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানু দাসের স্ত্রী অঞ্জলী রানী বলেন, ‘বইন্যায় আমাগো সব ডুইব্যা গেছিল। বইন্যার রাইতে ঘরে চৌকির ওপর বইয়া আছিলাম। নিচ দিয়ে স্রোত গেছে। ঘরের চারদিকে ভিটাও ধুইয়া নিছে। এখনো ঘরের মধ্যে পানি। ঘরবাড়ি সব ভাইসে গেছে, দুই দিন কোনো রান্না হয় না। স্রোতে চুলাও ভেঙে গেছে। বড় বিপদের মধ্যে আছি। ঘরের মধ্যে কাদায় হাঁটাচলা করা যায় না।
এলাকার লোকজন বলেন, এক সপ্তাহ ধরে ঘরের পানি সরছে না। এখনো তাঁরা পাননি কোনো সহায়তা। ঘরের বাইরে উঁচু স্থান থেকে রান্না করে আনছেন তাঁরা। এদিকে জলোচ্ছ্বাসের পর বাঁধ মেরামত করতেও কেউ আসেননি। এই অবস্থায় জোয়ারের পানি বাড়লে আবার বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে তাঁদের ঘর প্লাবিত হবে। এই আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে পায়রার স্রোতের তোড়ে নদীতীরবর্তী ইউনিয়নের মাটিভাঙ্গা, ফুলতলা, ভাজনা, তুষখালী ও ভুতুমিয়া গ্রামের অনেক স্থানের বেড়িবাঁধ ভেসে গেছে। ঝড়ের আঘাতে উপড়ে যাওয়া গাছপালা আর বিদ্যুতের খুঁটি এখনো সরানো হয়নি। যাঁদের ঘরের কিছু অংশ টিকে ছিল, দুপুরের জোয়ারের পানিতে সেটুকুও ভেসে গেছে। কিছু ঘর টিকে থাকলেও স্রোতের তোড়ে ভেসে গেছে মাটি দিয়ে তৈরি ঘরের ভিত।
ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আলমগীর হোসেন জানান, ২০০৭ সালের সিডরের পর আবার বেড়িবাঁধ ভেঙে পানিতে প্লাবিত হয়েছে পুরো ইউনিয়ন। পরবর্তী সময়ে বিকল্প বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সেই বাঁধের অনেক স্থান ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ভেঙে গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের পর ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে কিছু চাল বিতরণ করা হয়েছে। যাঁরা এখনো কোনো সহায়তা পাননি, তাঁদের সহায়তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ছোটবিঘাই ইউপির চেয়ারম্যান মো. আলতাফ হোসেন বলেন, ‘এখন আমাদের খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজন বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত করা। বাঁধ মেরামত না হলে উঁচু জোয়ারের পায়রা নদীর পানিতে আবার প্লাবিত হবে পুরো ইউনিয়ন। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) জানানো হয়েছে।’
পাউবোর পটুয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, মাটিভাঙ্গা এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। তাঁরা ঘটনাস্থল থেকে ঘুরে এসেছেন। ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ দ্রুত মেরামত করার উদ্যোগ নিচ্ছেন তাঁরা।