‘এখন আমার সংসার চলবো কেমনে?’
‘খেত থাইক্যা কাজ কইরা ভালা মানুষটা বাড়িতে আইলো। কিন্তু ভাইস্তা বউরে বাঁচাইতে যাইয়া কারেন্টের তারে লাইগা ভাইস্তা বউয়ের সঙ্গে নিজেও মইরা গেল। তিনজনের সংসারে উপার্জন করার আর কেউ নাই। এখন আমার সংসার চলব কেমনে?’
শেরপুরের নকলা উপজেলার টালকী ইউনিয়নের বিবিরচর মজিদবাড়ী গ্রামে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়া ফিরোজ মিয়ার স্ত্রী রুপালি বেগম বৃহস্পতিবার দুপুরে এভাবেই আহাজারি করতে করতে এসব কথা বলছিলেন। এই ঘটনায় ফিরোজ মিয়ার ভাতিজার স্ত্রী পারভীন আক্তারও মারা যান। আহত হয় ফিরোজের ছেলে রোকন। বুধবার সন্ধ্যায় উপজেলার বিবিরচর মজিদবাড়ী গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। মৃত ফিরোজ মিয়া মজিদবাড়ী গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে। আর গৃহবধূ পারভীন আক্তার মাসুদ মিয়ার স্ত্রী।
স্বামী ফিরোজ মিয়ার মৃত্যুতে অনেকটা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন রুপালি বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অত্যন্ত গরিব। কোনো জমিজমা নেই। এখন সংসার কীভাবে চালাবেন, তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ফিরোজ মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আকস্মিকভাবে দুজনের মৃত্যুর ঘটনায় পুরো গ্রামটিতে শোকের আবহ বিরাজ করছে।
মৃত ফিরোজ মিয়া ও পারভীন আক্তারের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফিরোজ মিয়া পেশায় কৃষিশ্রমিক ছিলেন। সারা দিন খেতে-খামারে কাজ করে যা মজুরি পেতেন তা দিয়েই সংসার চালাতেন। ভিটার জায়গা ছাড়া তাঁর কোনো কৃষিজমি নেই। ফিরোজ মিয়ার দুই ছেলে। বড় ছেলে রোকন টালকী ইউনিয়নের নয়াবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির আর ছোট ছেলে খোকন প্রভাতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।
স্বামী ফিরোজ মিয়ার মৃত্যুতে অনেকটা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন রুপালি বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অত্যন্ত গরিব। কোনো জমিজমা নেই। এখন সংসার কীভাবে চালাবেন, তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন।
অপর দিকে মৃত পারভীন আক্তারের স্বামী মাসুদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনিও একজন কৃষিশ্রমিক। তাঁর তিন মেয়ে। বড় মেয়ে মীম আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন। মেজ মেয়ে মারিয়া আক্তার স্থানীয় প্রভাতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। আর ছোট মেয়ে মিমিয়া আক্তারের বয়স মাত্র তিন বছর।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাসুদ বলেন, ‘ঘটনার সময় আমিতে বাড়িতে ছিলাম না। ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম। সংবাদ পাইয়া বাড়িতে ছুইটা আসি। দেখি সব শ্যাষ। আমি সারা দিন খেত-খামারে কাজ করতাম। পারভীনই সংসার আর পোলাপানগরে দেখত। এখন আমার মেয়েগরে দেখবে কে?’
সরেজমিনে দেখা যায়, বিবিরচর মজিদবাড়ী গ্রামে অন্তত ২০টি বাড়িতে অপরিকল্পিতভাবে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। একটি খুঁটি থেকেই ৮-১০টি ঘরে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সংযোগ দেওয়া তারগুলো অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। কোনো কোনো ঘরের টিনের চালের সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার জড়িয়ে আছে। মৃত পারভীন আক্তারের ঘরে বিদ্যুতের যে খুঁটি থেকে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে, সেটি সিমেন্টের নয়, কাঠের। পুরো খুঁটিটি বাঁশের ঝাড়ের সঙ্গে লেগে আছে।
বিবিরচর মজিদবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মালেক, এরশাদ আলী, অভিযোগ করে বলেন, বুধবার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুজনের মৃত্যুর ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা নয়। চার দিন আগে ঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত তারগুলো সঠিকভাবে মেরামত করে দেওয়ার জন্য তাঁরা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাঠকর্মীদের একাধিকবার অনুরোধ করেন। কিন্তু তাঁরা সেটি করেননি। এতে বুধবার বিকেলে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ বিবিরচর মজিদবাড়ী গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করার সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চালন লাইনের একটি তার গৃহবধূ পারভীন আক্তারের শরীরে ছিঁড়ে পড়ে। এতে পারভীনের শরীর ঝলসে যায়। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে তাঁর চাচাশ্বশুর ফিরোজ মিয়াও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন এবং দুজনই মারা যান। এই ঘটনার জন্য পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করেন এলাকাবাসী।
মৃত পারভীন আক্তারের স্বামী মাসুদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, অবহেলায় আর কেউ যাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ না হারান, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান তিনি।
জানতে চাইলে নকলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. মতিউর রহমান বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দুজনের মৃত্যুর ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুতের খুঁটি ও তার মেরামতের পরই বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়েছিল। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য ওই এলাকার বিদ্যুতের খুঁটি ও তার মেরামত করে দেওয়া হবে। পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় বিদ্যুতের ঝুঁকির বিষয়ে গ্রাহকদের আরও সচেতন করা হবে।
নকলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল কাদের মিয়া বলেন, এ ঘটনায় থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। পরিবারের আবেদনক্রমে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মৃত দুজনের লাশ দাফন করা হয়েছে।