বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনে অবশেষে ১৪-দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে ছাড় পেয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এর মধ্য দিয়ে আপাতভাবে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা নানা জল্পনার অবসান হয়েছে। তবে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে থাকায় বিষয়টি রাশেদ খান মেননকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে বলে মনে করছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা।
বাবুগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা জানা গেছে, ১৪-দলীয় জোটের মনোনয়ন পাকাপাকি হলেও আসন্ন নির্বাচনে বরিশাল-৩ আসনে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশে এখনো জটিলতা রয়ে গেছে। কারণ, এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির (জাপা) কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য গোলাম কিবরিয়া ওরফে টিপু। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা এখনো চূড়ান্ত না হওয়ায় জাপার এই প্রার্থী এবার লাঙল প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। এ ছাড়া একই আসনে বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আতিকুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তিনি একসময় রাশেদ খান মেননের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন এবং ওয়ার্কার্স পার্টির অঙ্গসংগঠন যুব মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ছিলেন। মেনন ও আতিকুরের বাড়ি উপজেলার দেহেরগাতি ইউনিয়নে। সে ক্ষেত্রে আতিকুর স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে সেটা মেননের জন্য বড় অস্বস্তির কারণ হতে পারে।
জাতীয় পার্টির বাবুগঞ্জ উপজেলা সাধারণ সম্পাদক মুকিতুল ইসলাম শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতবারও আমরা এখানে মহাজোটের অধীনে নির্বাচন করিনি। মহাজোটের নৌকার প্রার্থী ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ টিপু সুলতান। আমরা লাঙল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছিলাম। আর নৌকার প্রার্থী হয়েছিলেন তৃতীয়। কিন্তু এবার এখানে জাতীয় পার্টি সাংগঠনিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাই আমরা জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।’
তবে এসব বিষয়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন না স্থানীয় ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারা। দলটির জেলা সাধারণ সম্পাদক ও এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ টিপু সুলতান শুক্রবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির আসলে এখানে কোনো ভোট ব্যাংক নেই। মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে একটা সুযোগ পেয়েছে দলটি। এবার জাতীয় পার্টি মহাজোটের বাইরে নির্বাচনে যাচ্ছে। তাই আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের কোনো ভোট তাদের বাক্সে পড়বে না। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী আতিকুর রহমান এখনো আওয়ামী লীগের পরিচয়ে পরিচিত নন। তাই তাঁকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী হিসেবে কেউ বিবেচনা করছে না।’
জাতীয় রাজনীতির বর্ষীয়ান নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবার আকস্মিকভাবে বরিশালের দুটি আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন। এতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের মনোনয়ন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়ভাবে জোটকেন্দ্রিক রাজনীতিতে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়।
এই আসনে আওয়ামী লীগ শুরুতে মনোনয়ন দিয়েছিল সরদার খালিদ হোসেন ওরফে স্বপনকে। তিনি বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। রাশেদ খান মেনন জোটের সমর্থন পাওয়ায় খালিদ হোসেনের এবার দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই।
এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ১৪–দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে রাশেদ খান মেননের পক্ষে কতটা আন্তরিকভাবে মাঠে নামবেন, এ নিয়ে সংশয় আছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের দুজন নেতা বলেন, বরিশাল-৩ আসনে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারেননি কয়েক যুগ। বারবার আসনটি জোটের শরিক অন্য দলের প্রার্থীকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। শরিক দলের সংসদ সদস্যদের আনুকূল্য নিয়েই চলতে হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের। ফলে এখানে দলীয় নেতা-কর্মীরা নিজ দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারার কারণে প্রতিটি নির্বাচনেই নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এবার একজন স্বতন্ত্র, জাতীয় পার্টির বর্তমান সংসদ সদস্য এবং নৌকা প্রতীকের শরিক দলের প্রার্থী থাকায় একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এমন পরিস্থিতি রাশেদ খান মেননকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে।
বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান আকতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলের নিজস্ব প্রার্থী না থাকায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে মান-অভিমান, ক্ষোভ আছে, এটা ঠিক। তবে শেষ পর্যন্ত কেউই নৌকা প্রতীকের বাইরে যাবেন না। আমাদের নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ নির্দেশ দিলে সবাই ঐক্যবদ্ধ হবেন। এ ছাড়া জাতীয় রাজনীতির বর্ষীয়ান নেতা হিসেবে রাশেদ খান মেননের প্রতিও এলাকার মানুষের একটা উন্নত ধারণা আছে। এসব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনিই বিজয়ী হবেন।’
স্থানীয় ভোটার ও রাজনীতিকেরা জানান, রাশেদ খান মেনন ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালে বরিশাল-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে হিসাবে ২৮ বছর পর জন্মভূমি বরিশাল থেকে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ওই সময় এ আসনটি ছিল বাবুগঞ্জ-উজিরপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত। কিন্তু এখন আসনবিন্যাসের পর বরিশাল-৩ আসনটি বাবুগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলা নিয়ে গঠিত। আর উজিরপুর উপজেলাটি চলে গেছে বরিশাল-২ আসনের সঙ্গে। ফলে রাশেদ খান মেননের জন্য এটিও একটি চ্যালেঞ্জ।
রাশেদ খান মেনন ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এবার ওই আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে। ফলে রাশেদ খান মেননের মনোনয়ন নিয়ে শুরু থেকেই অস্বস্তি ছিল।
বাবুগঞ্জ ও মুলাদীর বেশ কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাবুগঞ্জ ও মুলাদী দুই উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছিলেন কয়েক ভাগে বিভক্ত। এদের বড় অংশ জাতীয় পার্টির প্রার্থী গোলাম কিবরিয়ার পক্ষে, কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী আতিকুর রহমানের পক্ষে কাজ করেছেন। ফলে ১৪ দলের নৌকার প্রার্থী ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ টিপু সুলতান ছিলেন অনেকটা অসহায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুলাদীর একজন কলেজশিক্ষক বলেন, ‘এবারও পরিস্থিতি যা দেখা যাচ্ছে তাতে দুই উপজেলায় আওয়ামী লীগ কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে যে যার মতো কাজ করবে। সে ক্ষেত্রে এবারও ১৪ দলের প্রার্থী হিসেবে রাশেদ খান মেনন চরম অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে পারেন।’