চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
এপ্রিলের টানা তাপপ্রবাহ মে মাসের প্রথম দিন আজ বুধবারও সমানে চোখ রাঙিয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা চুয়াডাঙ্গায়। জেলাজুড়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। সকালের দিকে আকাশে কিছুটা মেঘের আনাগোনা দেখা গেলেও বাকি সময় প্রখর রোদের সঙ্গে ভ্যাপসা গরম হাওয়ায় চারদিকে হাঁসফাঁস অবস্থা। অস্বস্তিতে গোটা জেলার মানুষ।
পৌর এলাকার হাটকালুগঞ্জে অবস্থিত প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সন্ধ্যা ছয়টায় জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করেছে।
পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, সকালের দিকে মেঘের আনাগোনা থাকায় সূর্যের আলো সে সময় ঠিকমতো ভূপৃষ্টে না পড়ায় তাপমাত্রা গতকাল মঙ্গলবারের তুলনায় দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমেছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আজ চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে একযোগে সারা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সন্ধ্যা ছয়টায় চুয়াডাঙ্গায় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৩৪ শতাংশ। আর্দ্রতা বেশি থাকায় ভ্যাপসা গরম অনুভূত হয়ে থাকে।’
অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবিলা বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন মো. কবির হোসেন। চুয়াডাঙ্গার চলমান অতি তীব্র তাপপ্রবাহ নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চলমান তাপপ্রবাহ ও বৈশ্বিক এই উষ্ণতার প্রভাব মোকাবিলায় চুয়াডাঙ্গা জেলা এবং আশপাশের এলাকার মানুষকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে জলাধার সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করতে হবে। আমরা জানি যে বৈশ্বিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি পেড়ানোর ফলে আজকে পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেকের সচেতনতা জরুরি। সেটা আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাস থেকে শুরু করে আহার, পরিধেয় পোশাক এবং জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে বিচরণ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, সবার প্রচেষ্টায় এই পৃথিবী বাসযোগ্য হবে। চলমান তাপপ্রবাহের ধারা থেকে আমরা সরে আসতে পারব।’
একদিকে মে দিবসের সরকারি ছুটি, অন্যদিকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে চুয়াডাঙ্গা শহরে মানুষের চলাচল তুলনামূলকভাবে কম ছিল। শহরকেন্দ্রিক শ্রমিকেরা এদিন অনেকেই ছুটি ভোগ করলেও গ্রাম এলাকায় রোদের কষ্টকে মেনে নিয়েই কৃষকসহ শ্রমজীবী মানুষ কাজে যোগ দেন। চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা সড়কে পৌর এলাকার ঘোড়ামারায় নির্মাণাধীন রাস্তার প্রয়োজনে খোয়া তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন খোকন আলী, রানা হামিদ, মো. বেল্টু মিয়া ও ফরজ আলী নামের চার শ্রমিক। পাতলা গামছা মাথায় জড়িয়ে তাঁরা কাজ করছিলেন। চারজনেরই বাড়ি আলমডাঙ্গার বন্ডবিল গ্রামে।
ছাতা মাথায় চড়া রোদের মধ্যে কাজ করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খোকন আলী বলেন, ‘আমরা কি আর শক কইরে ছাতা ছাড়া কাজ করি। জিনিসপত্তরের য্যারাম দাম বাইড়ে গিয়েচে, সংসার চালাতিই হিমশিম। ছাতা কিনব কী দিয়ে?’
এই চার শ্রমিকের কষ্টের বিষয়টি জেলা প্রশাসক কিসিঞ্জার চাকমাকে অবগত করলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ওই শ্রমিকদের ব্যবহারের উপযোগী ৪টি ছাতা, ২০টি করে খাবার স্যালাইন ও এক বোতল করে বিশুদ্ধ পানি পাঠিয়ে দেন।
এ ছাড়া অন্যান্য অসহায় খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশসহ সামাজিক সংগঠন সংযোগ ফাউন্ডেশন নগদ অর্থ, ছাতা, খাওয়ার স্যালাইন, বিশুদ্ধ পানি বিতরণসহ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া অন্তত ২২৫ জন শ্রমজীবী মানুষকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জনপ্রতি দুই দিনের হাজিরা হিসেবে নগদ ১ হাজার টাকা, এক প্যাকেট করে মুখে খাওয়ার স্যালাইন (ওআরএস) ও এক বোতল করে বিশুদ্ধ পানির বোতল উপহার দেওয়া হয়েছে। এসব উপহার জেলা প্রশাসক কিসিঞ্জার চাকমা বুধবার দুপুরে ডিসি সাহিত্য মঞ্চে কর্মহীন মানুষের (ইজিবাইকচালক, রাজমিস্ত্রী ও রিকশাচালক) হাতে তুলে দেন। এ সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) রিয়াজুল ইসলাম, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমা-তুজ-জোহরা এবং পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা উপস্থিত ছিলেন।
চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা সড়কের ঘোড়ামারা এলাকায় তপ্ত দুপুরে চার শ্রমিক রোদের মধ্যে খোয়া ভাঙার কাজ করছিলেন। বিষয়টি জানতে পেরে সেখানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. কবির হোসেনের মাধ্যমে চারজনের জন্য চারটি বড় ছাতা এবং প্রত্যেককে ২০টি খাওয়ার স্যালাইন ও বিশুদ্ধ পানি দেওয়া হয়।
মে দিবসের বিকেলে জেলা পুলিশের উদ্যোগে স্থানীয় বড়বাজার শহীদ হাসান চত্বরে শ্রমিকশ্রেণির কয়েক শ মানুষকে ছাতা, ক্যাপ, ওআরএস ও বিশুদ্ধ পানির বোতল উপহার ও শরবত পান করানো হয়। পুলিশ সুপার আর এম ফয়জুর রহমান উপস্থিত হয়ে বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন ও তদারক করেন। এ সময় সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেকেন্দার আলী ও জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক (ডিআইও-১) আবু জিহাদ ফকরুল আলম খানসহ পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সংযোগ ফাউন্ডেশনের সহযোগিতা ও সংযোগ ভলান্টিয়ার্স বাংলাদেশের উদ্যোগে শহরের একাডেমি মোড়ে দুপুরে ৫০০ জনের মধ্যে শরবত, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি ও স্যালাইন বিতরণ এবং ২০ জন রিকশাচালককে নতুন ছাতা উপহার দেওয়া হয়। এ ছাড়া সংযোগ ভলান্টিয়ার্স বাংলাদেশের সভাপতি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সিয়ামের নেতৃত্বে নিখরচায় শরীরের তাপমাত্রা ও রক্তচাপে মেপে সহযোগিতা করেন। এ সময় চুয়াডাঙ্গা জেলা টিম সমন্বয়কারী নাইম আকতার, সদস্য মুশফিকসহ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।